Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি বিরোধের জেরে প্রায়ই সঙ্ঘাত-সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত বা দুর্গম এলাকায় গেলে অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দা ভূমি মালিকানার জটিলতাকে অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। পার্বত্য চুক্তির কারণে নানা সুফলের কথা শোনা গেলেও সেখানকার জমির মালিকানা বা দখল নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে পাহাড়ি-বাঙালির দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের। যদিও পার্বত্য চুক্তির পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠিত হয়েছে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। কিন্তু এই কমিশনের কাঠামো, সংবিধানের প্রচলিত ধারার সাথে অসামঞ্জস্য এবং দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ। জমির মালিকানা প্রশ্নে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিসহ প্রায় সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই সম্প্রীতি-সহাবস্থানের বিষয়ে ব্যাপক টানাপড়েন চলছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকের জমি বাঙালিদের বিরুদ্ধে দখলের অভিযোগ করেছে। পাহাড়িদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে বাঙালি বাসিন্দাদের। অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দা ভূমি মালিকানার জটিলতাকে পার্বত্যঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে কথা হয় রাঙ্গামাটির জেলা শহরের কাছেই ছোট একটি পাহাড় বা টিলার বেশ কিছু অংশ সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়া কয়েকটি বাঙালি পরিবারের সাথে। অন্য দিকে সেই পাহাড়সংলগ্ন আরেকটি পাহাড় ও সমতলের কিছু অংশে বসবাস করে আসছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (চাকমা) ও ত্রিপুরা) কয়েকটি পরিবার। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পাশাপাশি বসবাস করলেও তেমন সমস্যা হয়নি। তবে ২০২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সংঘটিত সংঘর্ষ-ভাঙচুর ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের প্রতিবাদকারী পাহাড়িদের সাথে বাঙালিদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধে। শহরের বনরূপা বাজারে সৃষ্ট দাঙ্গায় অনীক চাকমা নামের ১ জন পাহাড়ি শিক্ষার্থী নিহত ও নারী-শিশুসহ ৫৯ জন আহত হয়। এ সময় দুর্বৃত্তরা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ প্রধান কার্যালয়, সীমান্ত ব্যাংক, সেভরন ল্যাব, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি-দোকানপাট পুড়িয়ে দেয় এবং ভাঙচুর, লুটপাট চালায়। দুর্বৃত্তদের আক্রমণ থেকে মৈত্রী বিহার ও মসজিদও বাদ যায়নি।
সেখানকার বাসিন্দারা বলেন, আমরা পাহাড়ে বসবাসকারীরা শান্তি চাই। কিন্তু কিছু দুষ্ট ও সুবিধাবাদী মানুষ রয়েছে, যারা পাহাড়কে উত্তপ্ত করতে মিথ্যা গুজব রটিয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে পার্বত্য অঞ্চলের বিষয়টি আমার মধ্যে পড়ে না আবার কয়েকটি অংশ পড়ে। আমাদের সংবিধানে যা আছে সেটাই আমি বলব। তিনি বলেন, সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাথে বৈঠক হয়েছে। তিনি প্রস্তাব করেছেন ‘জাতি বৈশিদ্ধ’ নামে পার্বত্য অঞ্চলকে জাতিগত নাম দেয়ার। আমি বলেছি সেখানে শুধু পাহাড়িরাই বসবাস করেন না, সব গোষ্ঠীরই সেখানে বসবাস। তাই সবাইকে রেখেই একটি কমিটি গঠন করতে।
সন্তু লারমার সাথে যে শান্তি চুক্তি হয়েছিল সেটি বাস্তবায়ন হয়নি আজো, যার ফলে গত ১৬-১৭ বছর ধরে এক পক্ষ তাদের আদিবাসী দাবি করছে, কিন্তু সংবিধানে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।
ভূমি জটিলতায় যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে তা সমাধানের পথ কি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সংবিধানকে বিশ্বাস করি। শান্তিচুক্তির বিষয়টি অনেক পুরনো ঘটনা। এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে। সেগুলো সময় নিয়ে কথা বলতে হবে। তবে এটা নিশ্চিত সংবিধানে যা আছে এটাই বাস্তব চিত্র। শিগগিরই এসব বিষয় নিয়ে আমরা বসবো।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: তৌহিদ হোসেন বলেন, পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার যে কাজটি আমাদের ছিল, তা আমরা করার চেষ্টা করছি। কিছু উপাদান (ফ্যাক্টর) রয়েছে, এখানকার অশান্তি থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবে। প্রতিটি সমাজে একটি শ্রেণী থাকে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, অশান্তি ও সঙ্ঘাত থেকে লাভবান হয় বলে তিনি জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের এক দশমাংশ আয়তনজুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান-তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। এ তিন জেলার মোট আয়তন ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বসবাস রয়েছে। অঞ্চলটি দেশের মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশ হলেও এখানে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। বাসিন্দাদের প্রায় অর্ধেক ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। বাকি প্রায় ৫১ শতাংশ বসবাসকারী বাঙালি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে-চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চংগ্যা, ম্রো, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, চাক ও খেয়াংসহ আরো একাধিক উপজাতি। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিতর্কিত নেতা ও তাদের পরিবার নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করে বিশ্বের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করে।
২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে ঞযব টহরঃবফ ঘধঃরড়হং উবপষধৎধঃরড়হ ড়হ ঃযব জরমযঃং ড়ভ ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষবং ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণাপত্রটি বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপক সুবিধা সংবলিত একটি আইনিকাঠামো। এর মাধ্যমে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী বা পক্ষে ভোট দানকারী রাষ্ট্রগুলো তার দেশের আদিবাসীদের জন্য ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বাধ্য। ২০০৭ সালে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পর হতেই কিছু সুবিধাবাদী উপজাতি নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে অযাচিতভাবে আদিবাসী হিসেবে দাবি করা শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ এই আদিবাসী স্বীকৃতি দাবির বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতি সন্তু লারমাও প্রাথমিক পর্যায়ে এই দাবির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে যখন তিনি উপলব্ধি করেন যে আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে তখন তিনি তার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসে আদিবাসী দাবির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।
আদিবাসী বিতর্ক : ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তিচুক্তির ‘ক’ খণ্ডের ১ নম্বর ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ১ নম্বর ধারায় পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ রকমভাবে পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে মোট ১৭ বার উপজাতি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হলে বাংলাদেশ অন্যান্য কয়েকটি দেশের সাথে ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী না থাকার কারণেই বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থাকে। বাংলাদেশ সরকার পত্রের মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘকে আদিবাসী বিষয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করে।
৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস আছে এই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে এখনো যে দ্বন্দ্বটা রয়ে গেছে, এ ছাড়াও শান্তি চুক্তির যে বাস্তবায়ন এটাকে আপনারা কিভাবে সমাধান করবেন?
এ প্রসঙ্গে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ (মারুফ) নয়া দিগন্তকে বলেন, সংবিধানে যেটা রয়েছে, দেশের আইনে যেটা রয়েছে এটাই আমাদের আনুষ্ঠানিক এবং দাফতরিক অবস্থান। সরকার রাষ্ট্রের যে নিয়মকানুন রয়েছে, সংবিধান রয়েছে, সংবিধান আলোকে যাকে যেভাবে পরিচিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে আমরা সেভাবে তাদেরকে পরিচিহ্নিত করছি। এর বাইরে এলে জেলা প্রশাসক হিসেবে।