CHT NEWS
২০২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে সেটলারদের হামলা ও অনিক চাকমাকে |
ডেস্ক রিপোর্ট, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ৮ আগস্ট ২০২৫
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত
হয়। এ সরকারের আজ ১ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির
তেমন কোন উন্নতি হয়নি। এই সরকারের এক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচার বহির্ভুত হত্যা,
সাম্প্রদায়িক হামলা, অন্যায় গ্রেফতার, তল্লাশিসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত
হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরের পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এ সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলের মতো ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের
ঘটনা ঘটেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী
দ্বারা বিচার বহির্ভুত হত্যার শিকার হয়েছেন ৬ জন (যাদের মধ্যে কেবল বম জাতিসত্তার ৫
জন রয়েছেন), আটক-গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন ৭২ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২৯ জন
(পুলিশ সদস্যসহ), হয়রানিমূলক তল্লাশির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৮৩ জনের বাড়িতে, ধর্মীয় পরিহানির
ঘটনা ঘটেছে ৩টি, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে আহত হয়েছেন ২ জন।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রাফিতি অঙ্কনে বাধা-হামলার
ঘটনা ঘটেছে।
এ সময়ে কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের, যারা সবাই বম জাতিসত্তার নাগরিক।
গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদপুষ্ট ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের হাতে খুনের
শিকার হয়েছেন ৬ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩৭ জন (বান্দরবানে ২৬ জন রাবার শ্রমিকসহ)
ও সমাবেশে হামলার ঘটনা ঘটেছে ২টি, এতে ১ জন গুলিবিদ্ধসহ ২ নারী আহত হন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপের হাতে খুন হয়েছেন ৭ জন,
অপহরণের শিকার হয়েছেন ৪১ জন, তাদের নির্বিচার গুলিতে আহত হয়েছে ১ শিশু এবং শারীরিক
নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অন্তত ২০ জন। এছাড়া রাঙামাটিতে ছাত্র-জনতার সমাবেশে বাধা ও
হামলার ঘটনা ঘটেছে।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটলার বাঙালি দ্বারা সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে
৪টি। এতে সেনাবাহিনীর গুলিতে ও নির্যাতনে নিহত হন ৩ জন এবং সেটলারদের হামলায় নিহত হন
১ জন।
এই সময়ে অন্তত ১৭ জন নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের
পর হত্যা করা হয় ১ জনকে, ধর্ষণের শিকার হন ৭ জন এবং ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার
হয়েছেন ৯ জন নারী।
ভুমি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে ৪টি স্থানে। বান্দরবানে ভূমিদস্যুরা অগ্নিসংযোগ
করে পুড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়িদের ১৭টি বসতবাড়ি।
অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পাহাড়িদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ সম্প্রদায়িক
হামলার ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে। এ
হামলায় দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনে নিহত হন ধন রঞ্জন চাকমা, খাগড়াছড়িতে
সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিতে নিহত হন কলেজ ছাত্র জুনান চাকমা ও রাজমিস্ত্রী রুবেল
ত্রিপুরা এবং রাঙামাটিতে সেটলারদের বর্বরোচিত হামলায় নিহত হন কলেজ ছাত্র অনিক চাকমা।
ভয়াবহ এসব হামলায় অন্তত ১৩৮ জন আহত হন এবং ৪ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন
স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ
৩ জন উপদেষ্টা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অপরদিকে সরকার একটি তদন্ত কমিটি করলেও সেই কমিটির
তদন্ত রিপোর্ট আজো প্রকাশিত হয়নি।
![]() |
দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে পাহাড়িদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে সেটলাররা। ফাইল ছবি |
![]() |
গণপিটুনিতে খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত (উপরে), নিহত জুনান চাকমা-রুবেল ত্রিপুরা (বামে) এবং দীঘিনালায় সেনাদের বর্বরোচিত নির্যাতনে নিহত ধন রঞ্জন চাকমা (ডানে)। ফাইল ছবি |
এ হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই খাগড়াছড়িতে স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে
গণপিটুনিতে এক শিক্ষকের মৃত্যু হলে, সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি শহরে
সেটলাররা আবারো পাহাড়িদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়িতে হামলা চালায়। এতে পাহাড়ি মালিকানাধীন
হাসপাতাল ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ফলে অন্তত ১৩ কোটি টাকার অধিক
মূল্যের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ হামলায় অন্তত ৬ জন পাহাড়ি আহত হন।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে খুন-গুমসহ মানবাধিকার
লঙ্ঘনে জড়িত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং উল্টো
তাদেরকে দিয়ে একই কায়দায় বিচার বহির্ভুত হত্যা, অন্যায় গ্রেফতার-আটক, নিরীহ গ্রামবাসীদের
ঘরবাড়িতে হয়রানিমূলক তল্লাশি, নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে।
এই ধারা এখনও চলমান রয়েছে। সেনা অভিযানের নামে প্রতিনিয়ত গ্রামে গ্রামে হানা, ধরপাকড়,
ঘরবাড়িতে তল্লাশি ও হয়রানির ঘটনা ঘটেই চলেছে।
এখনো হাসিনার আমলে সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পৃষ্ঠপোষকতা
দিয়ে যাচ্ছে। ঠ্যাঙাড়েরা খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ আগের মতো করে যাচ্ছে। অপরদিকে ফ্যাসিস্ট
হাসিনার দোসর সন্তু লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারে বহাল তবিয়তে রাখা হয়েছে এবং এভাবে
তাঁর পরিচালিত সশস্ত্র গ্রুপকে বিনা বাধায় খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ সংঘটন
করতে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
মোট কথা, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে আগের
ফ্যাসিস্টদের নীতি অনুসরণ করছে। সেনাবাহিনীকে দিয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন জারি রেখে পাহাড়িদেরকে
নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। ফলে ইউনূসের আমলেও পাহাড়ি জনগণ প্রতিনিয়ত
নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।