পাহাড়ি নারী ধর্ষণ ও সমতলের বাংলাদেশ

CHT NEWS

প্রতীকী ছবি

জানকি চাকমা



পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী ধর্ষণ-গণধর্ষণ বর্তমানে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বলতে গেলে পাহাড়ে এমন কোন দিন যায় না, যেদিন কোন না কোন পাহাড়ি নারী বা শিশু সেটলার অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ কিংবা যৌন হামলার শিকার হয় না। এই সমস্যার সূত্রপাত মূলতঃ ১৯৮০ দশক থেকে, যখন সমতল জেলাগুলো থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ৪ লক্ষ সেটলারকে নিয়ে আসা হয়। তার আগে পাহাড়ের লোকজন ধর্ষণ শব্দটির সাথে পরিচিত ছিল না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দশকের পর দশক ধরে পাহাড়ি নারীদের ওপর ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতার ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটতে থাকলেও তা রোধ করতে কোন সরকার আজ পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। কয়েক বছর আগেও অভিযুক্তরা সেটলার হলে তাদেরকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হতো না, শাস্তি দেয়া তো যোজন যোজন দূরের কথা। বর্তমানে আসামীদের গ্রেফতারে কিছু তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও কদাচিৎ বিচার ও সাজার খবর মেলে। আবার বিচারে দু’একটা ক্ষেত্রে সাজা হলেও জামিন লাভে তাদের কোন সমস্যা হয় না। যেমন রাঙ্গামাটির লংগদুতে আরএস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল রহিমকে ২০২২ সালে রাঙ্গামাটির আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু হাইকোর্টে মিথ্যা হলফনামা দিয়ে সে জামিন পেয়ে যায়। পাহাড়ে এমন ঘটনাও ঘটেছে, যেখানে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতারের পর আদালত থেকে জামিন পেয়ে অভিযুক্ত আসামী পুনরায় ধর্ষণ ক্রিয়ায় রত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন এমন জঘন্য ধর্ষণের ঘটনা বার বার ঘটে? এর একটি প্রধান কারণ হলো ধর্ষক সেটলাররা জানে তাদের পেছনে রাষ্ট্র (পড়ুন: সেনাবাহিনী, থানা পুলিশ ও আদালত) নামক একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা জানে ধর্ষণের দায়ে আটক হলেও তারা কয়েক দিন বা মাসের মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়ে যাবে এবং তাদের কোন সাজা হবে না।

এই তো গেল রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনসহ দেশের প্রগতিশীল উদারমনা বিভিন্ন সংগঠনগুলোর এক্ষেত্রে ভূমিকা কেমন? দু’একটি মানবাধিকার সংগঠন ধর্ষিতাদের আইনী ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে সত্য, কিন্তু বেশির ভাগ সংগঠনকে নিরব থাকতে দেখা যায়, তারা একটা বিবৃতি দিতেও কার্পণ্য করে থাকে।

ধর্ষণ কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে না, যদিও পাহাড়ে এর বিশেষত্ব ও ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। সমতলেও ধর্ষণের ঘটনা আকছার ঘটে। কিন্তু সমতলের ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো যেভাবে পত্রপত্রিকা ও সংগঠনের দৃষ্টি পায়, পাহাড়ের ঘটনাগুলো সে রকম পায় না।

আমরা সমতলে অনেক ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবাদে ব্যাপক ও দেশব্যাপী বিক্ষোভ দেখতে পাই। যেমন সর্বশেষ গত মার্চ মাসে মাগুরায় শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যার দেশব্যাপী বিক্ষোভ গড়ে উঠেছিল। ঘটনার প্রতিবাদে ও সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা মধ্যরাতে হল থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেছিলেন। একই দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও মিছিল ও সমাবেশ হয়েছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী ধর্ষিত হলে আমরা দেশের অন্যান্য জায়গায় তার প্রতিবাদ হতে দেখি না। (দু’একটি ব্যতিক্রম থাকতে পারে) পাহাড়ি সংগঠনগুলো ধর্ষণের বিরুদ্ধে কোন কর্মসূচি আয়োজন করলে প্রগতিশীল সংগঠনের নেতারা সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করে বড়জোর বক্তব্য দিয়ে থাকেন। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কোন প্রতিবাদ কর্মূসচি পালন করেন না। বলতে গেলে একের পর এক এত জঘন্য ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটার পরও পুরো দেশ নির্বিকার থাকে। যেন পাহাড়িরা বাংলাদেশের নাগরিক নন এবং তাদের দুর্দশায় সমতলের মানুষের কোন অনুভূতি নেই। ধর্ষণের মতো পাহাড়ের একটি বীভৎস সমস্যার প্রতি তাদের এই অচেতন থাকা পাহাড়ি জনগণকে চরমভাবে হতাশ করে। যেখানে দেশের প্রগতিশীল দল ও সংগঠন এবং নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমতলের মতো পাহাড়ে সংঘটিত যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কথা, সেখানে তাদের নিরব ভূমিকা পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসকগোষ্ঠীকেই লাভবান করে এবং এমনকি ধর্ষকদেরও উৎসাহ ও সাহস যোগায়।

আমরা সমতলের জনগণের এবং বিশেষত প্রগতিশীলদের এই নিরবতা ও নির্লিপ্ততার অবসান চাই। (২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫)


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *