Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল
পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছ থেকে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় করছে পাহাড়ে সক্রিয় চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন। ইউপিডিএফ (মূল), ইউপিডিএফ (ডেমোক্র্যাটিক), জেএসএস (মূল) ও জেএসএস (রিফর্মিস্ট) ছাড়াও কেএনএফ (কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট), ওয়াইডিএফ, পিসিপি ও এইচডব্লিউএফের মতো সহযোগী সংগঠনগুলোও এ চাঁদাবাজিতে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
আগের বছরগুলোর তুলনায় এ হার প্রায় দেড় গুণ বেশি। আগে বছরে এ চাঁদার পরিমাণ ছিল প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি রাঙ্গামাটিতে সরেজমিন গিয়ে ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে এবং চাঁদাবাজির রসিদ সংগ্রহ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
চাঁদার রসিদে নির্দিষ্ট হার : ‘পানছড়ি বাজার কাপড়, কসমেটিকস ও জুতার দোকান- বাৎসরিক পাস বাবদ ১৯০০ টাকা অনুমোদন প্রদান করা হলো; কার্যকর ১৫/১১/২০২৪ থেকে ৩১/১২/২০২৫’- এমন রসিদ নয়া দিগন্তের হাতে এসেছে। বাজারে দোকান খুলতে, নির্মাণকাজ চালাতে এমনকি কৃষিপণ্য বিক্রিতেও চাঁদা দিতে হচ্ছে।
ব্যবসা থেকে মসজিদ পর্যন্ত : চাঁদাবাজির শিকার শুধু ব্যবসায়ী বা ঠিকাদার নন; বাদ যায়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও। রাঙ্গামাটির বনরূপা এলাকায় মডেল মসজিদ নির্মাণের সময় অস্ত্রধারী পাঁচ-ছয়জন সন্ত্রাসী স্পিডবোটে এসে কাজ বন্ধ করে দেয় এবং ৪০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে হুমকির মুখে ঠিকাদার ২৫ লাখ টাকা দিয়ে কাজ শুরু করেন।
মসজিদের কেয়ারটেকার শরীয়তউল্লাহ বলেন, ‘অস্ত্র নিয়ে এসে কন্ট্রাক্টরকে কাজ বন্ধ করতে বলে। পরে চাঁদা দিয়ে কাজ শুরু হয়।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের মহড়া : রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও সম্প্রতি সশস্ত্র মহড়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ভয়ে ক্লাস ত্যাগ করতে বাধ্য হন। স্থানীয়রা জানান, নির্ধারিত হারে চাঁদা না দিলে অপহরণ, নির্যাতন, এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে।
অর্থ পাচার বিদেশে : ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এই চাঁদার টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। ভারতের মিজোরাম হয়ে তা উন্নত দেশে পাঠানো হয়, যেখানে সংগঠনের নেতাদের সন্তানদের পড়াশোনা, বাড়ি ও গাড়ি কেনার খরচ মেটানো হয়। এক সাবেক জেএসএস সদস্য জানান, ‘চাঁদা না দিয়ে একটি কলার ছড়িও বিক্রি করা যায় না পাহাড়ে। যারা দেয় না, তাদের অপহরণ বা হত্যা করা হয়।’
চাঁদাবাজির মূল খেলোয়াড় : ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে অন্তত আটটি গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে চাঁদাবাজিতে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে- ইউপিডিএফ (মূল), ইউপিডিএফ (ডেমোক্র্যাটিক), জেএসএস (মূল), জেএসএস (রিফর্মিস্ট), কেএনএফ (কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট), ওয়াইডিএফ (ইয়ুথ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট), পিসিপি (পার্বত্য ছাত্র পরিষদ), এইচডব্লিউএফ (হিল উইমেন ফেডারেশন)। এ ছাড়া মিয়ানমার ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এমএনপি) কাপ্তাই এলাকায় সক্রিয় বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সশস্ত্র মহড়া, এক কোটি টাকার দাবি : রাঙ্গামাটি পার্বত্য এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি ও উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নির্মাণ প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয়, সিএনজি পরিবহন, মৎস্য শিকার, কাঠ ব্যবসা এমনকি মোবাইল টাওয়ার পরিচালনাও চাঁদা ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
১০ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ সময় জেএসএস (মূল) সশস্ত্র গ্রুপের ছয়-সাতজন কাপ্তাই লেক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। তারা নিরাপত্তা প্রহরীর মোবাইল ফোন জব্দ করে শ্রমিকদের কাজ বন্ধের নির্দেশ দেয়। এক কোটি টাকা চাঁদা না দিলে কাজ চালাতে দেবে না এবং অবাধ্য হলে সবাইকে গুলি করার হুমকি দেয়।
এ সময় শ্রমিকদের কাছ থেকে ছয়টি অ্যান্ড্রয়েড ও চারটি বাটন ফোন ছিনিয়ে নেয় সশস্ত্ররা। পরবর্তীতে রকেট চাকমা নামে এক ব্যক্তি বারবার ফোন দিয়ে চাঁদা আদায়ের চাপ সৃষ্টি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো: সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। মুখোশ পরায় সন্ত্রাসীদের চেনা যায়নি।’
অন্য প্রকল্পেও চাঁদাবাজি : ৩ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির যুবলক্ষ্মীপাড়ায় একটি স্লুইসগেট ও কালভার্ট নির্মাণ কাজে ১২-১৪ জন অস্ত্রধারী পাহাড়ি সন্ত্রাসী এসে ৫ শতাংশ চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না পেয়ে তারা ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদারের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ৪টি অ্যান্ড্রয়েড ও ২টি বাটন ফোন ছিনিয়ে নেয়।
সিএনজিচালক-ব্যবসায়ীদের শোষণ : রাঙ্গামাটি জেলা অটোরিকশাচালক শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এক হাজার ৪১৬টি সিএনজি রেজিস্ট্রেশন রয়েছে, যার মধ্যে এক হাজার বাঙালি এবং ৪০০ পাহাড়ির মালিকানায়। পাহাড়ি এলাকায় চলতে হলে প্রতি সিএনজির জন্য মাসে এক হাজার ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। টোকেন না থাকলে সিএনজি আটকে রেখে ১০-১৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
এক মালিক জানান, ‘আমাদের চালক রতন কাপ্তাই হ্রদ এলাকায় টোকেন ছাড়া গিয়েছিল। তাকে ও সিএনজিকে গুম করে ফেলে। ১৫ বছরেও কোনো খোঁজ মেলেনি।’
মৎস্যজীবী ও কৃষকও রেহাই পাচ্ছেন না : কাপ্তাই হ্রদের মৎস্যজীবীরা জানান, বছরে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিয়ে মাছ ধরতে হয়। পাহাড়ে কাঠ কাটতেও চাঁদা দিতে হয়। বাজারে কলা আনতে ২০ টাকা, মুরগি বিক্রি করতে ১০ টাকা, আর গরু বিক্রিতে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।
মোবাইল টাওয়ারে হামলা : চাঁদা না দিলে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার ভাঙচুর করা হয়। চলতি বছরে তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত ৬টি টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জানা গেছে, বছরে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে টাওয়ারগুলো চালু রাখা হয়।
প্রশাসনের বক্তব্য : রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আঞ্চলিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজির কথা শুনলেও কেউ প্রকাশ্যে অভিযোগ করতে আসে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোশধারী সশস্ত্রদের প্রবেশের ঘটনা তদন্তাধীন।’
চাঁদাবাজির প্রভাব : এই চাঁদাবাজি শুধু সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘিœত করছে না, সরকারি প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যাহত করছে এবং সরকারি রাজস্ব আহরণ কমিয়ে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ভয় ও প্রতিশোধের আশঙ্কায় মুখ খুলছেন না, যা অপরাধীদের আরো বেপরোয়া করে তুলছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া : পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি কাজী মজিবুর রহমান বলেন, ‘৫৪ শতাংশ বাঙালি নানা হুমকির মুখে চাঁদা দেয়। বিদেশী ও সুশীল মহলের ইন্ধনে সন্ত্রাসীরা তৎপর।’
শুভলং বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানান, ‘শহরে সেনা টহল থাকায় মার্কেটে চাঁদাবাজি নেই, তবে আশপাশের এলাকায় নিয়মিত চাঁদা আদায় হয়।’
পাহাড়ি অধিবাসী মনিকা চাকমা বলেন, ‘চাঁদাবাজির কারণে আমরা অতিষ্ঠ।’
সমাধানের পথ : স্থানীয়দের মতে, পার্বত্য জেলার প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা দুর্গম হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পৌঁছানো কঠিন। দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। নানিয়ারচরের পদ্মা সেতু নামে পরিচিত নতুন ব্রিজ ইতিমধ্যেই শহরের সাথে সংযোগ সহজ করেছে, ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি এসেছে। পাহাড়ি ও বাঙালি উভয়েরই অভিমত- চাঁদাবাজি বন্ধ হলেই প্রকৃত শান্তি ফিরে আসবে পার্বত্য চট্টগ্রামে।