Google Alert – সশস্ত্র
পুরো গাজা দখলের সিদ্ধান্ত নেতানিয়াহুর
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা পুরোপুরি দখলের পরিকল্পনা ঘোষণা করতে চলেছেন। ইসরাইলি গণমাধ্যমের খবরে একথা বলা হয়েছে। নেতানিয়াহুর এই সিদ্ধান্তের ফলে গাজাজুড়ে সামরিক অভিযান আরও বাড়াবে ইসরাইলি বাহিনী। এর মধ্যে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের যেসব এলাকায় রাখা হয়েছে, সেই এলাকাগুলোও থাকবে। আই২৪নিউজ, দ্য জেরুজালেম পোস্ট, চ্যানেল ১২, ওয়াইনেট ও আলজাজিরা সোমবার এ খবর জানিয়েছে।
নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে চ্যানেল ১২-এর প্রধান রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমিত সেগা বলেছেন, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পূর্ণ আত্মসমর্পণ ছাড়া হামাস আর কোনো জিম্মি মুক্ত করবে না। আর আমরা আত্মসমর্পণ করব না। এখনই পদক্ষেপ না নিলে জিম্মিরা অনাহারে মারা যাবে। আর গাজা হামাসের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে যাবে।’ গাজা দখলের নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার খবরের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন রুখে দাঁড়াতে অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
বিষয়টি নিয়ে নেতানিয়াহুর কার্যালয় কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অনুরোধে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। গণমাধ্যমের এই প্রতিবেদন এমন সময়ে এলো যখন মঙ্গলবার ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। অবরুদ্ধ গাজায় চলমান যুদ্ধ দুই বছরের কাছাকাছি সময়ে পৌঁছানোর এই সময়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে এই বৈঠক ডাকা হয়েছে।
এদিকে ইসরাইলের হামলা ও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে গাজায় নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকার মধ্যে ভূখণ্ডটিতে আরও ত্রাণসহায়তা প্রবেশের সুযোগ করে দিতে এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে নেতানিয়াহুর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। গাজার চিকিৎসা সূত্রের হিসাবে, ইসরাইলের হামলায় সোমবার এক দিনেই গাজায় অন্তত ৭৪ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৬ জনই ছিল ত্রাণ সংগ্রহে যাওয়া মানুষ।
হামাসের হাতে থাকা বাকি জিম্মিদের মুক্ত করে আনার নিশ্চয়তা চেয়ে ইসরাইলের ভেতরেও চাপে আছেন নেতানিয়াহু। সম্প্রতি এক জিম্মির শীর্ণ চেহারার ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর এই চাপ আরও বেড়েছে। সোমবার হামাসকে নিরস্ত্র করাসহ তাদের হাতে থাকা বাকি জিম্মিদের মুক্ত করার লক্ষ্যের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন নেতানিয়াহু। মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের লক্ষ্য পূরণে আমাদের একতাবদ্ধ থেকে একসঙ্গে লড়তে হবে। এই লক্ষ্য হচ্ছে, শত্রুর পরাজয়, জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজা আর ইসরাইলের জন্য হুমকি নয় সেটি নিশ্চিত করা।’
ওদিকে হামাসের ঊর্ধবতন নেতা ওসামা হামদান যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে ইসরাইলের নৃশংসতায় চোখ বুজে থাকার অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, একগুঁয়েমি, ঔদ্ধত্য, যুদ্ধবিরতি চুক্তি করা নিয়ে ছলচাতুরী, বিধ্বংসী যুদ্ধ বাড়ানো এবং আমাদের মানুষজনকে অনাহারে রাখার কারণে ইসরাইলি জিম্মিদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার দায় পুরোপুরি নেতানিয়াহু সরকারের ওপরই বর্তায়।
গাজায় ইসরাইলি হামলায় গতকাল সোমবার অন্তত ৭৪ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে মৃত্যু হয় ৩৬ জনের। ভোররাতে এ হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারি সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। নাসের হাসপাতালের সূত্রের বরাতে আলজাজিরা জানায়, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে একটি তাঁবু লক্ষ্য করে ইসরাইলি বাহিনী বোমা হামলা চালালে অন্তত পাঁচজন নিহত হন। অন্যদিকে মধ্য গাজার নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরের উত্তরে ইসরাইলি কামান হামলায় আরও দুজন নিহত হন বলে জানিয়েছে আল-আওয়দা হাসপাতাল।
এ ছাড়া গাজা সিটির উত্তর-পশ্চিমে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় আরও দুই ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং কয়েকজন আহত হন বলে জানিয়েছে আল-শিফা হাসপাতালের কর্মীরা। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করে জানিয়েছে, ইসরাইলি বোমা হামলা, ত্রাণের অভাব, অনাহার ও অপুষ্টির কারণে গাজায় প্রতিদিন গড়ে ২৮ শিশু মারা যাচ্ছে। গাজার সরকারি গণমাধ্যম দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইল প্রতিদিন মাত্র ৮৬টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে, যা প্রতিদিনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ৬০০ ট্রাকের মাত্র ১৪ শতাংশ।
জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, গাজায় যে পরিমাণ ত্রাণ প্রবেশ করছে, তা অনাহারে থাকা জনগণের জন্য পর্যাপ্ত নয় এবং আমাদের ত্রাণবহরগুলো এখনও নানা বাধার মুখে পড়ছে। গাজায় মানবিক সহায়তার সমন্বয় তদারককারী ইসরাইলি সামরিক সংস্থা সিওজিএটি জানিয়েছে, তারা ধাপে ধাপে এবং নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গাজায় পণ্য প্রবেশের অনুমতি দেবে। এতে করে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা কমিয়ে আনা হবে বলে জানানো হয়েছে।
সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এর উদ্দেশ্য হলো-গাজা উপত্যকায় সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো এবং জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সহায়তা সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো।
সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, গাজায় আসা সব পণ্যই তল্লাশির আওতায় পড়বে। তবে অনুমোদিত ব্যবসায়ীরা কারা, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
গাজা সিটিতে কর্মরত চিকিৎসাসেবা সংস্থা ডক্টরস উইদআউট বর্ডার্সের প্রকল্প সমন্বয়কারী ক্যারোলিন উইলেমন জানিয়েছেন, অপুষ্টি ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে আহত ফিলিস্তিনিরা সঠিকভাবে সেরে উঠতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘তারা যেমনভাবে সেরে ওঠার কথা, তেমনভাবে হচ্ছে না। সবকিছুর ওপর তারা শুধু আহতই নয়, তাদের পর্যাপ্ত খাবারেরও অভাব রয়েছে। তাদের অনেকেই তাঁবুতে বাস করছে, যেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই।’ উইলেমন আরও বলেন, পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণরূপে বিভীষিকাময় ও বিভ্রান্তিকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরাইল। গত কয়েক সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মহল থেকে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ বেড়েছে। এতে আশা করা হচ্ছে, গাজা থেকে ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্ত করা সম্ভব হবে এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলো মানবিক সহায়তা বিতরণ করতে পারবে।
তবে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের কিছু মন্ত্রী এখনও গাজায় অভিযান চালিয়ে যাওয়ার এবং আংশিক বা পুরো অঞ্চল দখলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। চিঠিতে স্বাক্ষরকারী মোসাদের তিন সাবেক প্রধান হলেন-তামির পারদো, ইফ্রায়িম হেলেভি ও ড্যানি ইয়াতোম। অন্যদের মধ্যে শিন বেটের পাঁচ সাবেক প্রধান রয়েছেন। তারা হলেন-আয়ালন, নাদাভ আরগামান, ইয়োরাম কোহেন, ইয়াকভ পেরি ও কারমি গিলন। তিন সাবেক সেনাপ্রধানেরও নাম রয়েছে-সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন ও দান হালুটজ। চিঠিতে বলা হয়, ইসরাইলি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে এমন দুটি লক্ষ্য পূরণ করেছে, যেগুলো বলপ্রয়োগ ছাড়া অর্জন করা অসম্ভব ছিল। আর তা হলো, হামাসের সামরিক কাঠামো ও শাসনব্যবস্থা ধ্বংস করা। আরও বলা হয়, তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কেবল একটি চুক্তির মাধ্যমেই জিম্মিদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। এতে বলা হয়, হামাসের যেসব শীর্ষ নেতা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের পরেও আটক করা সম্ভব।
চিঠিতে সাবেক কর্মকর্তারা ট্রাম্পকে বলেন, আপনার প্রতি ইসরাইলিদের বড় অংশের আস্থা রয়েছে। আপনি চাইলে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগ করে যুদ্ধ বন্ধ এবং জিম্মিদের ফেরত আনার পথ তৈরি করতে পারেন।
তারা মনে করেন, যুদ্ধবিরতির পর ট্রাম্প একটি আঞ্চলিক জোট গঠনে নেতৃত্ব দিতে পারেন। যারা হামাসের বিকল্প হিসেবে গাজা শাসনের দায়িত্ব নিয়ে নতুনভাবে গঠিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দেবে।
এমএইচ