ফিকে হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বপ্ন

Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর হতে চললেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের নামে শুরু হওয়া জাতিগত নিধন, গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ভয়াবহতার কারণে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের সাথে আগে থেকে আশ্রিত কয়েক লাখ মিলে বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় বারো লাখ। শুরুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই মানবিক বিপর্যয়ে সহমর্মিতা দেখালেও সময়ের সাথে সাথে মনোযোগ এবং সহায়তা উভয়ই কমতে শুরু করেছে। অথচ প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া আটকে থাকায় শরণার্থী শিবিরে জীবনযাত্রা দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে, আর এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপরও।

বাংলাদেশ সরকার এবং মিয়ানমারের মধ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু চুক্তিটি ছিল আইনি বাধ্যবাধকতাহীন এবং অস্পষ্ট। প্রথম প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শুরু হলেও রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতা ও নাগরিক অধিকার না পাওয়ার শঙ্কায় স্বেচ্ছায় ফিরতে অস্বীকৃতি জানায়। মিয়ানমার সরকার গত এপ্রিল মাসে জানায় যে তারা এখন পর্যন্ত মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ‘প্রত্যাবাসনের জন্য যোগ্য’ বলে চিহ্নিত করেছে, যা মোট সংখ্যার খুবই সামান্য। তাছাড়া প্রত্যাবাসনের জন্য যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও জীবিকার নিশ্চয়তা সম্পর্কিত কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার।

২০২৫ সালের এপ্রিলে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশ ২০১৮–২০২০ সালে মিয়ানমারকে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গার একটি তালিকা জমা দিয়েছিল, যার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজারকে ‘প্রত্যাবাসনের যোগ্য’ হিসেবে মিয়ানমার স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া আরও ৭০ হাজারের যাচাই প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বাকি ৫ লাখের যাচাইকরণ ত্বরান্বিত করার প্রতিশ্রুতি মিয়ানমার দিয়েছে। তবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি খালিলুর রহমান স্পষ্ট করে বলেছেন যে, বর্তমানে রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে ‘নিরাপদ প্রত্যাবাসন’ সম্ভব নয়।

তবে রোহিঙ্গাদের দাবি—তারা সবাই নিজ দেশ মিয়ানমারেই ফিরতে চায়। কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে অপরাধপ্রবণতা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির কারনে জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে। টাইম ম্যাগাজিন জানায়, শিবিরগুলোতে সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, খাদ্য অনিয়মিতভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে, কমে যাচ্ছে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ধৈর্যও ফুরিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া চলতি বছর আন্তর্জাতিক তহবিলের ঘাটতি রোহিঙ্গাদের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

এছাড়া মায়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মির নতুন সহিংসতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ আরও কঠিন করে তুলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, আরাকান আর্মি এখন রাখাইন প্রদেশের অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্টীর ওপর চলমান নিপীড়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে — যেমন চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা, অনুমতি ছাড়াই কাজ বা ফসল তোলা নিষিদ্ধ এবং জোরপূর্বক শ্রম। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের উপর আর্টিলারি ও ড্রোন হামলা থেকে শুরু করে গ্রামে অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত করা হয়েছে। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। এই পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা বজায় রেখে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছে।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন এক আঞ্চলিক উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে আসিয়ান (ASEAN)। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ১২ আগস্ট কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের যৌথ আসিয়ান প্রতিনিধিদল শিগগিরই মিয়ানমার সফরে যাবে। এই মিশনের লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য অংশীজনদের সঙ্গে সরাসরি সংলাপের মাধ্যমে সহিংসতা বন্ধে চাপ সৃষ্টি করা। এছাড়া একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধানের পথও তৈরি করা। সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনুস মালয়েশিয়ার প্রতি কূটনৈতিক ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মানবিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করেন। আনোয়ার ইব্রাহিম স্বীকার করেন যে, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ যে চাপের মুখে রয়েছে, তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও উদ্বেগজনক।

সংকট থেকে উত্তরণ _

প্রথমে, প্রত্যাবাসন অবশ্যই স্বেচ্ছা, নিরাপদ এবং মর্যাপূর্ণ হতে হবে। মিয়ানমারকে নাগরিকত্ব, সম্পত্তি অধিকার, নিরাপত্তা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করেও পরিস্থিতি স্বচ্ছ ও নিরাপদ করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ, BIMSTEC, ASEAN, জাতিসংঘ এবং সংযোজিত শক্তিগুলো মিয়ানমারকে চাপ দিতে পারে যাতে তারা কেবল নামের জন্য নয়, সত্যিকার অর্থে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করে। চীন যেমন রাখাইন রাজ্যে তার বড় প্রকল্প ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে পারে, তেমনি বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কও একটি কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হওয়া উচিত।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার উন্নয়নেও অগ্রাধিকার দিতে হবে—শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা ও জীবিকার সুযোগ বাড়িয়ে তাদের আত্মশক্তি গড়ে তোলা জরুরি।

রোহিঙ্গা সংকট এখন কেবল একটি মানবিক বিপর্যয় নয়, এটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের পরীক্ষাক্ষেত্র। আট বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ এক অসীম ধৈর্য ও মানবিক দায়িত্ববোধ নিয়ে এই শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আসছে কিন্তু প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সহিংসতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। আরাকান আর্মির নতুন নির্যাতন হোক বা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পুরনো দমননীতি—এই চক্রাকার সহিংসতার মধ্যে রোহিঙ্গারা প্রতিদিন হারাচ্ছে তাদের ভবিষ্যতের নিরাপদ স্বপ্ন। তাই এখন কেবল সহানুভূতির ভাষণ নয় বরং প্রয়োজন কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ। সময় যত বাড়বে, তত গভীর হবে ক্ষত—যা পূরণ করতে হয়তো প্রজন্ম লেগে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *