ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, নতুন সরকারে কোনও দায়িত্বে থাকবো না: ড. ইউনূস

Bangla Tribune

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। নির্বাচন শেষে তিনি রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারে নির্বাচিত বা মনোনীত কোনও পদেই তিনি থাকবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেসেরেট নিউজে লেখা এক নিবন্ধে তিনি এ কথা বলেছেন। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ‘অ্যা মেসেজ ফ্রম দ্য লিডার অব বাংলাদেশ: জেন. জি ক্যান সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।

নিবন্ধে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন ড. ইউনূস। নিবন্ধটির ভাষান্তর বাংলা ট্রিবিউন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

এক বছর আগে এই মাসেই সমাজের সর্বস্তরের অগণিত মানুষের সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশের হাজার হাজার সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষার্থীরা আমাদের জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মাধ্যমে তারা একজন স্বৈরশাসককে গত বছর ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করে। যদিও এই আন্দোলন শেষ সময় পর্যন্ত নৃশংসভাবে দমন করা হয়েছিল।

এরপর ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়। দেশকে স্থিতিশীল করা এবং গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের পথ তৈরি করতে ছাত্রনেতারা আমাকে অন্তর্বর্তী সরকারে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। প্রথমে আমি রাজি হইনি। কিন্তু যখন তারা পীড়াপীড়ি করতে থাকলো, তখন আমি তাদের এবং আরও অনেক তরুণের জীবনের আত্মত্যাগ ও অঙ্গহানির কথা ভাবলাম। আমি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারলাম না।

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট আমি নীতি বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি মন্ত্রিসভার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করি।

শুরুটা হয়েছিল একটি আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ দাবি দিয়ে—সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিশ্চিত করা। কিন্তু এই আন্দোলনই বিশ্বের প্রথম জেনারেশন জেড বিপ্লবকে প্রজ্বালিত করে। এটি এখন একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে যে কীভাবে তরুণরা মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে পারে: যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং অসমতা।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিশ্চিত করার মতো এক সাধারণ দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা বিশ্বের প্রথম জেনারেশন জি বিপ্লবের সূচনা ঘটায়। যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং অসমতার মতো মানবজাতির বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় তরুণা কীভাবে এগিয়ে আসতে পারে সেটির জন্য একটি মডেল হয়ে ওঠেছে এই ঘটনা।

আমরা সৌভাগ্যবান যে তারা ‘তাদের পালা আসার’ জন্য অপেক্ষা করেনি। সভ্যতা যখন বিভিন্নভাবে ভুল পথে চালিত হচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে এখনই কিছু করার সঠিক সময়।

স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে আমাদের উত্তরণের সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণগুলোর একটি ছিল যখন দি ইকোনমিস্ট ২০২৪ সালের জন্য বাংলাদেশকে তাদের ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করে। আমরা তখন অর্থনীতি পুনর্গঠন, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং চুরি হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ উদ্ধারে এত ব্যস্ত ছিলাম যে আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি যে বিশ্ব আমাদের অগ্রগতিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। আমাদের এই যাত্রার ওপর ডেসেরেট নিউজের চমৎকার কভারেজ ছিল প্রশংসনীয়।

আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল পূর্ববর্তী শাসনামলে নৃশংসভাবে নিহত ও আহত হাজার হাজার মানুষের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। আমরা তাদের শোকে সমব্যথী। আমরা সাবেক সরকার এবং তার অনুচরদের লুট করা অর্থ উদ্ধারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অনুমান করে যে গত ১৫ বছরে এই শাসনব্যবস্থা বছরে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। এই অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করা অপরিহার্য; এর গুরুত্ব অপরিসীম।

যখন আমি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন অব্যবস্থাপনার মাত্রা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। পুলিশ তাদের দায়িত্ব ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছিল। হাজার হাজার মানুষ রাষ্ট্র পরিচালিত নির্যাতন কেন্দ্রে ধুঁকছিল। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পর্যাপ্ত আনুগত্য না দেখানোর কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তারা ন্যায়বিচার দাবি করছিলেন।

ধীরে ধীরে আমরা পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছি। যেসব রাজনৈতিক দল স্বৈরাচারের প্রতিরোধ করেছিল, তারা নতুন গঠিত দলগুলোর পাশাপাশি নতুন ধারণা, শক্তি ও পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের ওপর গণহত্যা চালানোর আহ্বানের মুখে প্রশংসনীয় সংযম দেখানো সশস্ত্র বাহিনী পেশাদারত্ব বজায় রেখেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে।

আমি এটি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছি: আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি পরবর্তী সরকারে কোনও নির্বাচিত বা মনোনীত পদে দায়িত্ব পালন করবো না।

আমাদের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। বিদেশে বসবাসকারী নাগরিকদেরসহ সব যোগ্য নাগরিকের ভোট দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা এখনও একটি বিশাল কাজ। কিন্তু আমরা এটি সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের এবং বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক জোরদার করতে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও নতুন করে সাজিয়েছি।

বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে এবং হবে। আমরা বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন এবং সেক্রেটারি রুবিওর সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ। সম্প্রতি তার সঙ্গে আমাদের উভয় জাতির জন্য উপকারী বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর একটি ফলপ্রসূ ও বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।

যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ এবং জাতিসংঘও আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। আমরা এই যাত্রায় একা নই।

নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি আমরা একগুচ্ছ ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব করেছি। এসব প্রস্তাব তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের, রাজনৈতিক দলগুলোকে এবং নাগরিকদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধানের একটি সংশোধনী। যা ক্ষমতার চেক  অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করবে, যাতে বাংলাদেশ আর কখনও স্বৈরাচারের কবলে না পড়ে।

আমি আমাদের বিশ্বজুড়ে থাকা প্রবাসীসহ বাংলাদেশি তরুণদের প্রশংসা ও ধন্যবাদ জানাই। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর প্রতি হতাশা থেকে পুনর্গঠনের একটি রূপরেখা তৈরি করা যায়। তাদের সাহস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা এবং ত্যাগ প্রয়োজন।

তাদের উদাহরণ আমাদের এই আশা জাগায় যে আরও বেশি জেনারেশন জি সদস্য, পাশাপাশি তাদের দাদা-দাদি ও বাবা-মা, যারা জেনারেশন এক্স ও মিলেনিয়ালস এবং তরুণ ডিজিটাল নেটিভ জেনারেশন আলফা–তারা এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলবে যাকে আমি বলি ‘তিন শূন্যের বিশ্ব’: শূন্য বেকারত্ব, শূন্য দারিদ্র্য এবং শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ।

বাংলাদেশ যদি অবশেষে এমন একটি দেশে পরিণত হয় যেখানে এর সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, তবে তা হবে আগামী মাস ও বছরগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশির দৃঢ়তা, কল্পনা ও সাহসের ফল।

এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যারা আমাদের সঙ্গে অংশ নেওয়ার সুযোগ ও দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আমাদের ইউটাহ রাজ্যের অনেক বন্ধুও আছেন, তারাই আমাদের সর্বোত্তম আশা এবং হয়তো আমাদের শেষ ভরসা।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *