দেশ রূপান্তর
ভারতীয় টিভি চ্যানেল ‘স্টার জলসা’র একটা স্লোগান-বদলে যাও, বদলে দাও। মনে পড়ল যে জন্যে। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির সাক্ষাতে দলটির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটা দাবি করেছেন। তা হল বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারকে নির্বাচন সামনে রেখে বদলে যেতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুডে আনার তাগিদ দিয়েছেন। কয়েকজন দল ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাকে বাদ এবং প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে দলীয়করণমুক্ত করার কথা তারা বলেছেন। পরের দিন জামায়াতে ইসলামীও তাদের বিচারে বিএনপিমনা উপদেষ্টা ও প্রশাসকদের বাদ দিতে বলেছে। এনসিপির নেতারা মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে বলেছেন, কোনো উপদেষ্টাকে বাদ দেয়া যাবে না। প্রশাসনকে বিএনপি, জামায়াত বাটোয়ারা করে নিয়েছে। আর গণভোট করার আগে তত্ত্বাবধায়ক অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার করা যাবে না।
সরকার প্রধানের সঙ্গে এহেন সংলাপ এমন সময়ে হল যখন সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে সংবিধানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাতিল করা কেয়ারটেকার ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তনের চূড়ান্ত শুনানি হচ্ছে। সবার ধারণা হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী এ ব্যবস্থা ফিরে আসবে তবে প্রশ্ন হচ্ছে কখন থেকে? এখন থেকেই তা ফিরে এলে অন্তর্বর্তী সরকার আর থাকবে না, নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির যে সব কথাবার্তা হল, এতে করে চলমান মামলার শুনানিতে প্রভাব ফেলে কি না- তা অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যায় না। বর্তমান সরকার ভোট পর্যন্ত থাকতে চায় এটা পরিষ্কার। ভোট উৎসবের ডেকোরেটরের দায়িত্ব পালনের কৃতিত্ব নেবার আঙ্ক্ষকা প্রবল।
ইউনূস সরকারকে বদলে যাবার আহবান জানিয়ে বিএনপি এ কথার জানানও দিয়েছে যে ড. ইউনূসের ওপর তাদের আস্থা গভীর। তিনিই যেন উপদেষ্টা পরিষদে এবং প্রশাসন ও বিচার বিভাগে দায়িত্ব নিয়ে সংস্কার ঘটান। কিন্তু ভোটের তফসীল হয়ে গেলে প্রশাসন যে নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়, সে প্রশ্নের নিষ্পত্তি কি হবে? এখন এটা পরিস্কার বিএনপি এবং জামায়াতের দাবিকে একসঙ্গে করলে ষ্পষ্ট হয়ে যায়, বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার আর নিরপেক্ষ নেই। এনসিপিও বলেছে, কিছু উপদেষ্টা সেফ এক্সিটের জন্য গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণার সঙ্গে বেঈমানি করে বিএনপিকে ভোটে জেতানোর জন্য কাজ করছেন। ড. ইউনূসের ওপর তাদের গোস্বা হচ্ছে, তিনি বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কোন্ কোন্ উপদেষ্টাকে ড. ইউনূস বাদ দেবেন? বিএনপি নাম বা জানালেও দু’জন ছাত্র-প্রতিনিধি উপদেষ্টা এবং একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টার কথা উঠছে। এই জ্যেষ্ঠকে তা নিয়ে সংশয় বেশি নেই। কেননা যোগাযোগ উপদেষ্টা ফওজুল করীব নিজের ফেসবুকে স্বীকার করেছেন। তাঁর নামে অভিযোগ এসেছে। এর আগে বিএনপি তিনজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল। জামায়াতে ইসলামী কোন কোন উপদেষ্টা বিএনপিমনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাও প্রকাশ করেনি। তবে বিভিন্ন আদালতে পিপি-জিপির ৮০ ভাগ বিএনপি’র-এ কথা বলেছে। এই বিচারে এটর্নী জেনারেল এডভোকেট আসাদুজ্জামানও বাদ যাবেন না।
কেননা তিনি বিএনপি’র মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন এবং বর্তমানে এ পদে থেকেও রাজনৈতিক কথা বার্তা বলেন। তদুপরি তিনি ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ভোটে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। বর্তমান এটর্নী জেনারেলের নিয়োগ হয়েছিল অর্ন্তবর্তী সরকারের গঠনের আগেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপীল বিভাগ রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দিয়েছেন অর্ন্তবর্তী পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টাদের নিযুক্ত করার জন্য। ক্ষমতাটা রাষ্ট্রপতির’ ড. ইউনূসের নয়। রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সম্পর্ক এবং সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে এই দুইজনের সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনা আছে। বিএনপি’র একরকম ছায়া মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ প্রকাশ্যেই বলেছেন, ড. ইউনূসকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ফেলতে হবে।
আরেকটা কথা না বললেই নয়। মাস তিনেক আগে শীর্ষ দৈনিক ‘প্রথম আলো’র একটা গোলটেবিল বৈঠকে শোনা গিয়েছিল যে, বর্তমান সরকারের মধ্যে আরেকটা সরকার আছে। বর্তমান সরকার সেফ এক্সিট খুঁজছে। বিজ্ঞজনের মতে, ইউনূস সরকার ‘প্রথম আলো’ থেকে কাওরান বাজারের আরেক প্রভাবশালী দৈনিক ‘আমার দেশ’-এর দিকে রওনা দিয়েছে বলে এমন উদ্বেগ। নীতিগত দৃষ্টিকোনে। কেননা সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা প্রথম আলো’র কলাম লেখক বা প্রদায়ক ছিলেন। বিএনপি ও জামায়াতের উপদেষ্টা পরিষদ পরিচ্ছন্ন করার আহ্বানে সেটাই তো প্রমাণ হল।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাটা হচ্ছে এমন যে সংবিধান কার্যকর আছে এবং প্রয়োজন মাফিক বিপ্লবের চেতনাও প্রয়োগ হচ্ছে। জুলাই সনদ বা প্রস্তাবিত সংবিধান আদেশ অবশ্যই এর মাধ্যমে সাংবিধানিক ব্যত্যয়গুলো হয়ত পুষিয়ে নেবার চেষ্টা থাকবে। অবশ্য সরকার প্রধানের এ আদেশ জারী করার ক্ষমতা নেই। সংবিধান বহাল থাকলে তখন আদেশ হতে পারে? কিন্তু জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কৌশল, গণভোট বা পিআর নিয়ে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির মধ্যে যে জটলা বেঁধেছে তার নিরসন কি ভাবে হবে? গত ১৪ অক্টোবর ঐতিহাসিক জুলাই সনদ সই হয়েছে এনসিপির অনুপস্থিতির মধ্যে দিয়ে। সই করেছে ঐকমত্য কমিশন এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের বাছাই করা ২৪টি দলের নেতারা। চলতি মাসে মিশরে গাজার যুদ্ধ বিরতি আনার যে চুক্তি হয়েছে সেই অনুষ্ঠানের সঙ্গে জুলাই সনদ চুক্তি অনুষ্ঠানের মিল দেখতে পারে কেউ কেউ। ওই চুক্তি অনুষ্ঠানে বিবাদমন দুই পক্ষ হামাস ও ইসরাইল যেমন ছিল না, সংসদ চত্বরে সনদ সইয়ের অনুষ্ঠানে জুলাই যোদ্ধারা ও ছিলেন না। গাজার চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে যেমন এখন দৌঁড় ঝাপ চলছে, সনদের রূপায়ন নিয়েও যথেষ্ট গ্যাঞ্জাম মালুম হচ্ছে। আগামী কয়েকটা দিন
‘বদলে যাও, বদলে দাও’ আহ্বানের অবস্থা কি দাঁড়ায়, তা সাব্যস্ত করতে পারে আসন্ন শীতের উত্তপ্ত রাজনীতি।
লেখক- জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও মহাসচিব, জনতা পার্টি বাংলাদেশ
