The Daily Ittefaq
২৪-এর গণআন্দোলনের পর মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। তারা ন্যায্য অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারবে—এমন একটি দেশ তারা ফিরে পাবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মানুষ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
প্রতিবারই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলে মানুষের মধ্যে একধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। ২৪-এর গণআন্দোলনের পর সরকার পরিবর্তিত হলে মানুষের মনে যে উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তেমন কোনো সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। ব্যাংকিং এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে কিছুটা অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল কিন্তু সেই সাফল্য এখন মন্থর হয়ে পড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক দিন ধরেই মন্থর হয়ে আছে। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় আহরিত না হওয়ার কারণে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। উপরন্তু অনেক কলকারখনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চালু কারখানাগুলোও তাদের উৎপাদনক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না। কলকারখানায় প্রতিনিয়ত ঘটছে চাকরিচ্যুতি ও শ্রমিক ছাঁটাই। ফলে বেকার সমস্যা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে দেশে আইনের শাসন বজায় থাকা খুবই জরুরি। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অবলীলাক্রমে মব সন্ত্রাস চলতে দিয়েছে এবং তাদেরকে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে মানুষ মনে করছে। ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। প্রতিবারই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে কয়েক দিনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও দ্রুতই তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। এবার তার ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে।
দেশে বর্তমানে বহু পাওয়ার সেন্টার সৃষ্টি হয়েছে। বহুবিধ পাওয়ার সেন্টারের কারণে সাধারণ মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না আসল পাওয়ার সেন্টার কোথায় অবস্থিত। ক্ষমতা বহুকেন্দ্রিক হলে শাসনকার্য পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। আর একটি উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে—অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা দেশীয় স্বার্থ রক্ষায় যতটা তৎপর, তার চেয়ে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভূরাজনৈতিক এজেন্ডা বস্তবায়নে বেশি আগ্রহী। সাধারণ মানুষ কার্যত নিজেদের প্রতারিত মনে করছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আন্দোলনের মাধ্যমে যত সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, তার কোনোটিই গণপ্রত্যাশামতো কাজ করতে পারেনি। বর্তমান সরকার একই পথে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে। কমিশন দীর্ঘদিন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কিছু ব্যাপারে ঐকমত গঠনের চেষ্টা করছে। জুলাই সনদের মাধ্যমে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ‘৭২-এর মূল সংবিধান বাতিলের লক্ষ্য নিয়ে জুলাই সনদ প্রণীত হয়েছে। কিছু নীতিগত মৌলিক মতপার্থকের কারণে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে আমরা এই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈষম্য দূরীকরণ এবং ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। বৈষম্য দূরীকরণ ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের আড়ালে শেখ হাসিনার দুরন্ত কর্তৃত্ববাদী শাসন ও জনবিচ্ছিন্নতার কারণে সাধারণ মানুষও আন্দোলনে শরিক হয়। সেই আন্দোলনের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তারা আন্দোলনের নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থানের প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে, যা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর দায় শেখ হাসিনাকেই বহন করতে হবে। কারণ তার আমলে এমন অপশাসন প্রতিষ্ঠা না করা হলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতিতে এভাবে প্রবেশ এবং অবস্থান তৈরি করে নিতে পারত না। বিগত সরকার যদি দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখত, তাহলে বাইরে থেকে কোনো অপশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটত না। কোনো সরকারের যদি জনসম্পৃক্ততা থাকে, তাহলে সেখানে কোনো অপশক্তির উত্থান ঘটে না। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এখন দুর্দণ্ডপ্রতাপে জাতিকে হুমকি দিয়ে চলেছে। তারা বিভিন্নভাবে শক্তি সঞ্চয় করছে। শান্তিপ্রিয় মানুষ এটা চায় না। তারা এখন কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে শুরু করেছে—ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সামাজ্যবাদী শক্তি যে পাওয়ার গেম খেলছে, তার ফলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এমন অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এত দীর্ঘ সময় নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাদের প্রাথমিক কিছু সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত ছিল। নেপালের ক্ষেত্রে আমরা কী দেখলাম? ক্ষমতায় বসার পর নেপালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কারণেই একাধিক পাওয়ার সেন্টারের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হলে দেশ একটি পাওয়ার সেন্টারে চলে আসত। মানুষ তাদের দাবিদাওয়া জানাতে পারত। সরকারের দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহি তৈরি হতো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ই বিদেশি শক্তির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বাংলাদেশে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করাটা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক রণনীতি আছে। তারা তাদের সিনেট ও কংগ্রেসে বার্মা অ্যাক্ট পাশ করিয়ে রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের জিও-পলিটিকসে চীনকে ঘেরাও করা। ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোয়াড চুক্তি আছে। কিন্তু বর্ধিত শুল্কারোপ প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা টানাপড়েন চলছে। সব মিলিয়ে এই অঞ্চলে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বাগরাম বিমানঘাঁটি প্রশ্নে আফগানিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যার সঙ্গে নাগাল্যান্ড, মণিপুরের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যোগসূত্র রয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।
আমাদের সেনাবাহিনী খুব ভালো ভূমিকা পালন করছে। তবে তাদের আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, বিশেষ করে মব সন্ত্রাস দমনে তাদের তৎপর হওয়া প্রয়োজন। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস ও বেআইনি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর
আরো অধিক ভূমিকা দেখতে চায় দেশের মানুষ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৈরি প্রেশার গ্রুপ দমনে সেনাবাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে না। পুলিশ বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা সৃষ্টিতে আরো সময় লাগবে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনীকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে অগ্নিগর্ভ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে দেশে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আগামী নভেম্বর মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করা হতে পারে। নানান বিবেচনায় আগামী নভেম্বর মাসটি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই সনদ হবে দেশের প্রচলিত সংবিধানের ঊর্ধ্বে। এটা নিয়ে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ে মতভেদ দেখা যাচ্ছে। জামায়াত ও অন্য আরো কয়েকটি দল চাচ্ছে গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জুলাই সনদকে বাস্তবায়ন করা হোক। আমরা চাচ্ছি নির্বাচিত সরকার সংসদে বিল উপস্থাপনের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একধরনের দায়মুক্তি চাচ্ছে। কিন্তু এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সরকার যদি সৎ উদ্দেশ্যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করে থাকে, তাহলে তো তাদের দায়মুক্তি চাইতে হবে কেন? অতীতে যত আন্দোলন হয়েছে, তার কোনোটিতেই যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের দায়মুক্তি নিতে হয়নি। দায়মুক্তি কারা চায়? যাদের ভয় আছে। তোমরা যদি সঠিক কাজ করে থাকো, তাহলে দায়মুক্তির প্রশ্ন আসবে কেন ? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি দায়িত্ব গ্রহণের পর ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করত, তাহলে দায়মুক্তি বা নিরাপদ প্রস্থান বা সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন আসত না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জননন্দিত হয়ে থাকতে পারত।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) অনুলিখন : এম এ খালেক
