বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থি দলগুলোর উত্থান নিয়ে আলোচনা, উদ্বেগ কোথায়?

Google Alert – বাংলাদেশ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডানপন্থিদের উত্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অনেকে

অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডানপন্থিদের উত্থানের বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। সভা-সমাবেশে কিংবা সংস্কার ও নির্বাচনের মতো ইস্যুগুলোতে বেশ সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে ইসলামপন্থিদের। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে রাজনীতিবিদসহ বিভিন্নজনকে।

গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডে ডানপন্থিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ শোনা গেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উদ্বেগ প্রকাশের পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে।

কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ডানপন্থি রাজনৈতিক দলের উত্থান নিয়ে রাজনীতিবিদ ছাড়াও বিভিন্ন পেশার মানুষকে শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। যদিও ‘হঠাৎ করে উত্থানের’ বিষয়টি একেবারেই নাকচ করে দিচ্ছে ইসলামপন্থি দলগুলো।

তাদের দাবি, গত ১৫ বছর যে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে, ফ্যাসিবাদের পতনের পর তারা সেই অধিকার ফিরে পেয়েছে।

অন্য অনেক রাজনৈতিক দল দৃশ্যপটে অনুপস্থিত থাকায় ডানপন্থি দলগুলোর কর্মকাণ্ড বেশি চোখে পড়ছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অগাস্টের অভ্যুত্থানের পর দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে সেটার সুযোগ নিচ্ছে ডানপন্থি দলগুলো।

তবে এর প্রভাব কতদূর গড়াবে, তা নির্ভর করবে নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনের ওপর।

আরও পড়তে পারেন:
নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে মহাসমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে মহাসমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম

“এরাতো সবাই এদেশে ছিল, এদেশে রাজনীতি করতো”

গত ১৯শে জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী।

সেই সমাবেশে দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, “আগামী দিনের জাতীয় সংসদে শুধুমাত্র ইসলাম চলবে। কোরান এবং সুন্নাহর আইন চলবে। মানুষের তৈরি করা কোনো মতবাদকে জাতীয় সংসদে আর যেতে দেয়া যাবে না।”

তার আগের মাসের ২৮ তারিখে একই জায়গায় মহাসমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায় তারা।

তেসরা মে নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে মহাসমাবেশ করে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।

এছাড়াও সংস্কার, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনায় গুরুত্ব পেতে দেখা গেছে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোকে।

ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডানপন্থিদের উত্থান হচ্ছে, আছে এমন আলোচনা। যদিও এই দাবি মানতে নারাজ ইসলামপন্থি দলগুলো।

"এমন কোনো শক্তির উত্থান দেখছেন না" ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, “এমন কোনো শক্তির উত্থান দেখছেন না” ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব

দক্ষিণপন্থিদের উত্থান নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের উদ্বেগের বিষয়টি আলোচনায় এলে এর প্রতিক্রিয়া জানায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

লিখিত এক বিবৃতিতে তারা জানায়, বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভুল বার্তা দেবে।

“আমরাও বাংলাদেশে রাজনীতি করছি। আমরা তো এমন কোনো শক্তির উত্থান দেখছি না,” বিবৃতিতে উল্লেখ করেন দলটির মহাসচিব ইউনুস আহমদ।

অনেকটা একই কথা বলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।

“দক্ষিণপন্থি বলতে আপনি কাকে মিন করবেন? উত্থান শব্দের ব্যাখ্যা কী? এখানে কোনো শক্তি এমন নেই যে নতুন করে এদেশে জন্ম নিয়েছে। কোনো আনক্সপেক্টেড পাওয়ারতো (অপ্রত্যাশিত শক্তিতো) এখানে আসেনি। এরাতো সবাই এদেশে ছিল, এদেশে রাজনীতি করতো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. পরওয়ার।

“আপনি ১৫ বছর তাকে কথা বলতে দেননি। সে যদি আজকে বড় একটা সমাবেশ করে, আপনি তাকে কি বলবেন একটা শক্তির উত্থান? বরং সে অধিকার ফিরে পেয়েছে,” বলেন এই জামায়াত নেতা।

এদিকে গণঅভ্যুত্থানে ইসলামপন্থি দলসহ বিভিন্ন শক্তির ভূমিকা থাকায়, দক্ষিণপন্থি ভাবাদর্শের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে রাজনৈতিকভাবে এর ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।

“সরকারের মধ্যেও বলি না অনেকগুলো সরকার কাজ করছে? কখনো প্রশাসনে, কখনো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে, তারাও কিছুটা শক্তি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে,” বলেন এই বামপন্থি নেতা।

অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি নিজেদের মধ্যপন্থি দল হিসেবে দাবি করলেও বিভিন্ন সময় ইসলামপন্থি দলগুলোর সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা দৃশ্যমান হয়েছে।

নানা সময় দলগুলোর সমাবেশে উপস্থিত থেকে তাদের দাবি-দাওয়ায় সমর্থন দিতেও দেখা গেছে এনসিপির নেতাদের।

সম্পর্কিত আরও খবর:
গত এক বছরে বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডে ডানপন্থিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত এক বছরে ডানপন্থিদের উত্থানের বিষয়ে নানা আলোচনা আছে।

বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডে ডানপন্থিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থি দলগুলো এখন সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে বলে বিভিন্ন সময় বক্তব্য-বিবৃতিতে উল্লেখ করতে দেখা গেছে উদার ও মধ্যপন্থি দলের নেতাদের।

নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে ইসলামপন্থি দলগুলোর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টির বিষয়টিও দৃশ্যমান হচ্ছে। যার একটি উদাহরণ, দুই সদস্যকে নিয়ে ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের আপত্তির মুখে পাঠ্যপুস্তক সমন্বয় কমিটি বাতিল।

“হেফাজতে ইসলাম বা এ জাতীয় যে রাইট উইংগাররা (ডানপন্থিরা) আছে, এই শক্তিটাকে আমরা দেখেছি সবসময় আওয়ামী লীগের খুব কাছাকাছি ছিল,” বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।

“সেই রাজনৈতিক শক্তিটা যখন দেখি এখন এসে বিশাল বড় একটা কেউ কিছু, এই প্ল্যাটফর্ম যখন খুব গুরুত্ব নিয়ে কথা বলে এবং তাদের যেকোনো কথায় যেকোনো কাজ হয়, তখনতো খুব অবাক লাগে যে এটা কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।

হিযবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনও গত মার্চে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকায় খেলাফত কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। যদিও টিয়ারশেল ও সাউন্ডগ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়।

এছাড়াও গত এক বছরে রোজার সময় খাবারের দোকান বন্ধ, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙা, থিয়েটার বন্ধ, বাউলদের বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর ও নারীদের ফুটবল ম্যাচ বাতিল কিংবা ওড়না না পড়ায় হেনস্তার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে ডানপন্থিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ছিল।

“এই বিষয়গুলোই প্রমাণ করছে জবরদস্তি করে তারা একটা দক্ষিণপন্থা এখানে চাপিয়ে দিতে চায়। এটা যদি আরও সংঘটিত রূপ নেয়, তখন সেটা অবশ্যই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় হবে”, বলেন বামপন্থি নেতা সা‌ইফুল হক।

"প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ এগিয়ে নিলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে দেশে এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে"

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, “প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ এগিয়ে নিলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে দেশে এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে”

অন্য রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতেই দৃশ্যমান ডানপন্থিরা

গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে গত ২১শে জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)।

এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ এগিয়ে নিলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে বাংলাদেশে এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে।

এর আগে, এই বছরের পয়লা এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরের শিরোনামেও বলা হয়, অভ্যুত্থানের পর কট্টরপন্থিরা বাংলাদেশে নতুন করে সুযোগ নিচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে দক্ষিণপন্থিদের উত্থানের বিষয়টিই বারবার আলোচনায় আসছে। যদিও এর সঙ্গে একমত নন, ইসলামপন্থি রাজনীতি পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক শরীফ মুহাম্মদ।

বরং অন্য দলগুলোর অনুপস্থিতিই ডানপন্থি দলগুলোকে রাজনীতির মাঠে অনেক বেশি দৃশ্যমান করে তুলছে বলে মনে করেন তিনি।

বিবিসি বাংলাকে মি. মুহাম্মদ বলেন, “বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতিটা নতুন না। এখন যেহেতু বামপন্থিদের সাথে এলায়েন্স করা প্রধান সেক্যুলার দল সিনে নাই, এজন্য এদের (ডানপন্থিদের) প্রতিটা মিটিং, প্রতিটা বক্তব্য চোখে পড়ছে।”

“অনেকভাবে এটাকে চিহ্নায়িত করতে পারেন যে তাদের প্রভাব অনেক বেশি, অথবা তারা ক্ষমতার কাছাকাছি চলে গেছে কি না, আমার কাছে এমন মনে হয় না। আমার কাছে দৃশ্যটা স্বাভাবিকই মনে হয়,” যোগ করেন তিনি।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *