Google Alert – বাংলাদেশ
বাংলাদেশে জোর করে ঠেলে পাঠানো আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ভারতীয় নাগরিক সোনালি বিবির পরিবারের দেশটিতে পাঁচ প্রজন্ম আগের জমির রেকর্ড আছে। ২০ জুন দিল্লিতে একজন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা সুনালি বিবিকে স্বামী দানিশ এবং আট বছরের ছেলে সাবিরকে সহ রোহিনীর বাঙালি বস্তি থেকে আটক করে পুলিশ। একপর্যায়ে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, সোনালি বিবি, তার ছেলে এবং স্বামীকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।২৯ বছর বয়সী সোনালি বিবির পৈতৃক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়। তার গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা তাকে ভারতীয় বলে স্বীকার করেছেন। স্বাক্ষী দেওয়া এসব ব্যক্তির মধ্যে সোনালির প্রসবকারী ধাত্রীও রয়েছেন।
মে মাস থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত রাজ্যগুলিতে হাজার হাজার বাংলাভাষী অভিবাসী শ্রমিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের বাংলাদেশে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যদিও তারা ভারতীয় নাগরিক।
জোসরা বিবি দাবি করেন, সুনালি, তার স্বামী এবং ছেলের সাথে ঠিক এমনটাই ঘটেছে। অথচ পরিবারটির পাঁচ প্রজন্ম পুরোনো জমির রেকর্ড রয়েছে।
দিল্লির অভিযান
পুলিশ সোনালির রোহিনীর বস্তিতে অভিযানে গেলে তিনি তাদের আধার কার্ড এবং রেশন কার্ড দেখান। সোনালির বোন কারিশমা রোহিনী বস্তিতে তার বাড়ির পাশেই থাকতেন। তিনি বলেন, পুলিশ তাদের জন্ম সনদ দেখতে চেয়েছিল, যা তাদের কাছে ছিল না।
পুলিশি অভিযানের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে একটি অগ্নিকাণ্ডে সোনালির ছেলের জন্ম সনদটি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ তাদের কথা বিশ্বাস করতে রাজি হয়নি। তাদের আটকের ছয় দিন পর ফরেনার্স’স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসের একটি আদেশের ভিত্তিতে সোনালি, দানিশ এবং সাবিরকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রোল ওই আদেশ এবং দিল্লি পুলিশের রেকর্ডের বরাত দিয়ে জানায়, পরিবারটি নাকি স্বীকার করেছে, তারা বাংলাদেশের বাগেরহাটের বাসিন্দা।সোনালির পরিবারের সদস্যরা এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। তারা বলেন, তারা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বাসিন্দা। তাদের এই দাবি স্থানীয় রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলামও সমর্থন করেছেন। তিনি তাদের বহিষ্কারের বিরুদ্ধে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
২ মে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনা অনুযায়ী এই ধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে। এতে বলা আছে, কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে পুলিশকে অবশ্যই ব্যক্তির নিজ রাজ্যের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে তাদের নাগরিকত্বের অবস্থা যাচাই করতে হবে।
কিন্তু সোনালির গ্রাম বীরভূমের একটি থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অফিসার স্ক্রোলকে বলেন, দিল্লি পুলিশ সোনালি, তার স্বামী এবং তাদের ছেলেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর আগে কোনো ধরনের যাচাই-বাচায়ের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করেনি।কারিশমা অভিযোগ করেছেন, দানিশ এবং সোনালির তথাকথিত স্বীকারোক্তি পুলিশ দ্বারা তৈরি করা হয়েছে।
“তারা আমাদের বস্তি থেকে অনেক লোককে আটক করেছিল। যারা ঘুষ দিয়েছে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ আমার বোনের কাছ থেকে এই স্বীকারোক্তি জোর করে আদায় করেছে কারণ সে ঘুষ দিতে পারেনি”, বলেন তিনি।রোহিনীর কে.এন. কাটজু মার্গ পুলিশ স্টেশনের একজন অফিসার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যেহেতু বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের আটক করা হচ্ছে এবং অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে ভারতীয় প্রমাণ করতে বাধ্য হওয়া পরিবারগুলির সাথে কথা বলেছে স্ক্রল।
মেয়ের আটকের কয়েক সপ্তাহ পর জোসরা বিবি তার গ্রামে ফিরে আসেন। তার সাথে ছিল সোনালির সাত বছরের মেয়ে আনিসা খাতুন, যে তার ভাইয়ের ভাগ্য থেকে রক্ষা পেয়েছিল কোনোভাবে। কারণ অভিযানের সময় সে তার মায়ের সাথে ছিল না।
পরিবারটির দাবি যাচাই করার জন্য স্ক্রোল পাইকর গ্রামে যায়। আমরা এমন গ্রামবাসীদের খুঁজে পেয়েছি যারা নিশ্চিত করেছেন, তারা বহু প্রজন্ম ধরে সেখানে বসবাস করছেন, এমন জমির রেকর্ড পেয়েছি যা একই বিষয়টি প্রমাণ করে। এমনকি যেই ধাত্রী ২৫ বছর আগে সোনালিকে প্রসব করিয়েছিলেন তাকেও আমরা খুঁজে পেয়েছি।
নাগরিকত্ব পরীক্ষা
সোনালি খাতুনের বাবা-মা পাইকর গ্রামে একটি মাটির কুঁড়েঘরের দুটি ঘরে থাকেন। তার বাবা ৬১ বছর বয়সী ভাদু শেখ সারাদিন হাঁটু গেড়ে বসে থেকে বাড়ির খেয়াল রাখেন আর তামাক চিবান। বয়স তাকে ধীর করে দিয়েছে কিন্তু তিন দশকেরও বেশি আগে, তিনিই ছিলেন তার পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি দিল্লিতে চলে গিয়েছিলেন।
রাজধানীতে একজন হকার হিসেবে, তিনি এমন টাকা রোজগার করতেন যা গ্রামে একটি প্রভাবশালী পরিবারের জন্য বিনা বেতনে কাজ করে রোজগার করা অসম্ভব ছিল। পরবর্তী বছরগুলিতে দম্পতি প্রায়শই পাইকর থেকে দিল্লি যাতায়াত করত।“আমরা এর আগে কখনো দিল্লিতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি। কেউ আমাদের অতীতে বাংলাদেশী বলেনি”, বলেন জোসরা বিবি।
তাদের মেয়ে সোনালি এবং কারিশমা তাদের সাথে চলে যায় এবং শেষ পর্যন্ত শহরে কাজ শুরু করে। তার আধার কার্ড অনুযায়ী, সোনালি খাতুন ২০০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন।জন্মসূত্রে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতে নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী তার জন্মের সময় তার বাবা-মায়ের মধ্যে অন্তত একজন ভারতীয় নাগরিক হতে হবে।
ভাদু শেখ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যদিকে, জোসরা বিবি বিবাহের পর মুর্শিদাবাদ থেকে পাইকরে আসেন। কিন্তু, ভারতের বেশিরভাগ গ্রামীণ মানুষের মতো তারা বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন এবং তাদের জন্ম সনদ নেই।
স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই ভোটার কার্ড আছে। আমরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে ভোটার তালিকা খুঁজে তাদের সত্যতা যাচাই করেছি। আমরা পশ্চিমবঙ্গের মুরারই বিধানসভা কেন্দ্রের ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় তাদের নামও পেয়েছি, যা ইসিআই অনলাইনে আপলোড করেছে।সুনালির দাদা-দাদির নামও তালিকায় রয়েছে।
ভাদু শেখ আমাদের তাদের বাড়ির জমির দলিলও দেখিয়েছেন। এতে তার নাম ছিল। “আমরা জীবনে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু আমরা এই বাড়িটি কখনো ছেড়ে যাইনি,” যোগ করেন সোনালির দাদি হাসানেহেনা বিবি।
মেয়ে দিল্লিতে আটক হওয়ার পর ভাদু শেখ স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে একটি তথ্য অধিকারের আবেদন করেন যারা জমির রেকর্ড রাখেন। তিনি তার পৈতৃক বাড়ির আরও প্রমাণ খুঁজে পান। তিনি যে নথিগুলি পেয়েছেন, যার মধ্যে একটি ১৯৫৬ সালের। তাতে দেখা যায়, পরিবারটি বহু প্রজন্ম ধরে পাইকরে বসবাস করে আসছে – সোনালির প্রপিতামহ আমিরউদ্দিন শেখ পর্যন্ত। স্ক্রোল সেই নথিগুলি দেখেছে।
পরিবারের একজন প্রতিবেশী এবং দূর সম্পর্কের আত্মীয় রকি শেখ বলেন, “এমনকি মোদি নিজেও আপনাকে এতগুলি নথি দেখাতে পারবেন না।’’তাদের কাছে যে একটি নথি ছিল না তা হলো সোনালির জন্ম শংসাপত্র।
কিন্তু জোসরা বিবির সাথে আমরা তাকে প্রসব করিয়েছিলেন এমন ধাত্রীকে খুঁজতে পাইকর গ্রামে সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেদিন তিনি আসেননি। আমরা তার বাড়ির দিকে একটু হেঁটে গেলাম, যেখানে আমরা জ্বর থেকে সেরে ওঠা ভগীরথী রবিদাসকে পেলাম।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই দুর্বল বৃদ্ধা গ্রামের মহিলাদের সন্তান প্রসব করতে সাহায্য করেছেন। তিনি জোসরা বিবির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আমি সোনালি এবং তার অন্য দুই সন্তানকেও প্রসব করিয়েছি। তারা বাংলাদেশী নয়। আমি তাদের পরিবারকে এখানে অনেক দিন ধরে দেখছি।”
পাইকর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে সুভেন্দু দাস নামে একজন কর্মীও আমাদের বলেন, সোনালির পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে গ্রামে বসবাস করছে। “তার বাবা দিল্লিতে যাওয়ার আগে গ্রামে আচার বিক্রি করে ঘুরতেন,” বলেন তিনি।পরিবারটি সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ করা সত্ত্বেও সোনালি এবং বাকিরা এখনো বাংলাদেশে আটকে আছেন।
২১ আগস্ট পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন বাংলাদেশের পুলিশ তাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করে। সেখানেও তাদের “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে, জানিয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
এদিকে, তার বাবার কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন, যা তিনি জুলাই মাসে দাখিল করেছিলেন, ১০ সেপ্টেম্বর শুনানির জন্য নির্ধারিত আছে।কিন্তু রাজ্যসভার সংসদ সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারপারসন সামিরুল ইসলাম, যিনি পিটিশনে সাহায্য করেছেন, তিনি চিন্তিত যে, বিচার ব্যবস্থার চাকা খুব ধীর গতিতে ঘুরছে।
তিনি বলেন, “আমার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো সোনালি গর্ভবতী। যদি সে বাংলাদেশে প্রসব করে? সেই শিশুর আইনি অবস্থা কী হবে?”এই চিন্তা করে জোসরা বিবি কান্নায় ভেঙে পড়েন। “আমি ভাবছি সে কোন অবস্থায় আছে,” তিনি বলেন।
সর্বশেষ জোসরা বিবি সোনালিকে ১৯ জুলাই একটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ভিডিওতে দেখেছিলেন। “আমার নাতিকে খুব পাতলা দেখাচ্ছিল। আগে সে গোলগাল ছিল। আমি জানি না তাদের ফিরতে আর কতদিন লাগবে”, বলেন তিনি।