Google Alert – বাংলাদেশ
এক বছর আগে বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ছাত্রদের ওপর নির্মম দমন-পীড়ন চালান। তখন আবু সাঈদ রংপুর শহরে সশস্ত্র পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে সাহসী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, দুই হাত প্রসারিত করে প্রতিবাদ জানান। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে আহত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
গণ-অভ্যুত্থানে নিহত প্রায় এক হাজার ৪০০ জনের মধ্যে আবু সাঈদ একজন। এই অভ্যুত্থানেই শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তিনি এমন একটি দেশ ছেড়ে যান, যা অরাজকতার শেষ সীমায় পৌঁছেছিল। তবে আশার আলোও ছিল।
ছাত্ররা বাংলাদেশের পুনর্গঠন চেয়েছিলেন। তাঁরা একটি বৈষম্যহীন এবং কম দুর্নীতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক দেশ চেয়েছিলেন। এই আশা নিয়ে তাঁরা নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগে সহায়তা করেন। বাংলাদেশকে অস্থিরতা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজটি গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
তবে অনেক বাংলাদেশি পরিবর্তনের ধীরগতি নিয়ে হতাশ। তারা ভাবছে, আবু সাঈদের মতো প্রতিবাদকারীরা কি তাঁদের জীবন বৃথাই ত্যাগ করেছেন! নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিপ্লবের এক বছর পর বাংলাদেশের পরিবর্তনের ধীরগতি ঘিরে উদ্বেগ, অর্থনীতি ও পরিচিত সমস্যাগুলো নির্মূল না হওয়া নিয়ে বিশদ আলোচনা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখনো দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি এবং গেঁথে বসা আমলাতন্ত্রের মতো প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাগুলো দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে। এসব সমস্যাও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছিল।
এদিকে ছাত্ররা চাইছেন, গণতান্ত্রিক সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়িত হোক। তাঁরা চাইছেন, গত বছরের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় যেসব রাজনৈতিক দলের সদস্য ও পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত তাঁদের দ্রুত শাস্তি কার্যকর হোক।
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের সংস্কারের ভার এখন ড. ইউনূসের কাঁধে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে এখনো বিভাজন রয়েছে এবং এখানে প্রায় ৬০টি রাজনৈতিক দল সক্রিয়। ড. ইউনূসের প্রথম কাজ ছিল আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যদিও এখন বাংলাদেশ কিছুটা স্থিতিশীল।
ইউনূসের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল, একটি ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি শুরু করা। এ লক্ষ্যে সংস্কারের প্রস্তাব দিতে তিনি ১১টি কমিশন তৈরি করেন, যার মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশ সংস্কার অন্তর্ভুক্ত। এর সামগ্রিক লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে যেসব প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন এনেছিলেন, সেগুলোর সংস্কার করা। কিন্তু এই সংস্কারের কমই বাস্তবায়িত হয়েছে।
গত সপ্তাহে ড. ইউনূস ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশের পুনর্গঠিত ভোটিং সিস্টেমের অধীনে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধের কারণে এখনো অনেক বিষয়ের সমাধান বাকি রয়েছে।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের শক্তি হারানোর পর বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিএনপি। দলটি জোর দিয়ে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে শুধু মুক্ত ও ন্যায়সংগত নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত। অন্যান্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের হাতে রাখা উচিত। তবে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী দল জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আরো সংস্কারের পর নির্বাচন চাইছে।
বাংলাদেশের কমিশনগুলোর সংস্কার প্রস্তাব তদারকি করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল দুই মাস ধরে সংবিধান ও শাসন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। এই আলোচনায় কোনো তিক্ত বাক্য বিনিময় হয়নি, যা অগ্রগতির আশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটিয়ে তোলে। বিভিন্ন দল স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও প্রধানমন্ত্রী পদে মেয়াদের সীমাবদ্ধতার মতো বিষয়গুলোতে একমত হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দলগুলো গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকায় তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকার থেকে বেরিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেন।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের বছরপূর্তির দিন ঢাকায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ সন্ধ্যার হালকা বৃষ্টির মধ্যে ইউনূসের ভাষণ শোনার জন্য জমায়েত হয় রাজধানীতে। ইউনূস ভাষণে বলেন, ‘গত বছরের গণ-আন্দোলনে যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁদের জাতীয় নায়ক হিসেবে গণ্য করা হবে এবং বাংলাদেশ শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা ও ছাত্র আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষা দেবে। এটি শুনে অনেক শ্রোতাই উল্লাস প্রকাশ করে।’ তবে এই উদযাপন ঢাকা পড়ে যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভে। কারণ ২০২৪ সালের জুলাই মাসের হত্যার দোষীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি এখনো পূর্ণ হয়নি।
ট্রাইব্যুনাল হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে হাসিনার বিরুদ্ধে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার চালাচ্ছেন। গত সপ্তাহে তিনি ভারত থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, যেখানে তিনি ছাত্র বিপ্লবকে কঠিনভাবে অর্জিত গণতন্ত্রের একটি সহিংস ব্যাঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলাদেশের নেতৃত্বকেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে মানবাধিকারকর্মীদের কাছে। তাঁরা বলছেন, নতুন বাংলাদেশে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশে অর্থনীতি ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এ অবস্থায় বেশির ভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, গত বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালের চেয়ে ৫.৮ শতাংশ থেকে কমে ৪.২ শতাংশে নেমেছে।