বাবার জন্য সন্তানের যুদ্ধ : শুভর গল্প এখন ‘সুখবর বাংলাদেশের’ পাতায়

Kalbela News | RSS Feed

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সুখবর বাংলাদেশ’ বইটি বাংলাদেশের অদম্য ও অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষদের গল্প তুলে ধরেছে। এই বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে এক তরুণের অবিশ্বাস্য সংগ্রামের কাহিনি- বাবাকে ক্যানসারের হাত থেকে বাঁচাতে শুভ সরকার ও তার ছোট ভাইয়ের এক অসম যুদ্ধের গল্প। এটি শুধু এক সফল ফ্রিল্যান্সারের গল্প নয়, বরং সন্তানের ভালোবাসার, ত্যাগের এবং জয়ের এক জীবন্ত দলিল।

সংকটের সূচনা
গল্পের শুরু ২০২০ সালে। ঢাকার আজিমপুরের বাসিন্দা ও সরকারের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রুবেল মিয়ার জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার অধ্যায়। হঠাৎ করেই তিনি জানতে পারেন, তিনি ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত। এক স্বল্প আয়ের পরিবারে ক্যানসারের মতো ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসা যেন এক আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। ভবিষ্যতের চিন্তায় যখন পরিবারটি দিশাহারা, তখনই রুবেল মিয়ার বড় ছেলে, ১৮ বছর বয়সী শুভ সরকার বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে বলে, ‘বাবা চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এক যোদ্ধার জন্ম
তৎকালীন এইচএসসি পরীক্ষার্থী শুভ জানত, বাবাকে বাঁচানোর এই যুদ্ধে তাকেই সেনাপতির ভূমিকা নিতে হবে। আগে থেকেই কম্পিউটার গ্রাফিক্সের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। সেই আগ্রহকে বাস্তবে রূপ দিতে ঢাকার ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটে মোশন গ্রাফিকস কোর্সে ভর্তি হয় সে। কিন্তু মাত্র ১৫ দিন ক্লাস করার পরই দেশজুড়ে শুরু হয় করোনা মহামারি।

তবে কোনো বাধাই শুভর পথচলা থামাতে পারেনি। বাসায় বসে অনলাইনেই সে কোর্সটি সম্পন্ন করে। নিজের চেষ্টায় শুরু করে থ্রিডি অ্যানিমেশন শেখা। বাবার জমানো টাকায় কেনা একটি কম্পিউটারই ছিল তার এই যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র। বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে, বিশেষ করে ‘ফাইভআর’-এ সে গ্রাফিক্স ডিজাইনের ছোট ছোট কাজ দিয়ে নিজের যাত্রা শুরু করে।

দুই ভাইয়ের যুগলবন্দি

ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। শুভর দক্ষতা ও নিষ্ঠা তাকে মোশন গ্রাফিক্সের বড় কাজ এনে দেয়। আয় বাড়ার সাথে সাথে বাবার চিকিৎসাও পুরোদমে চলতে শুরু করে। বড় ভাইয়ের এই সংগ্রাম দেখে বসে থাকতে পারেনি ছোট ভাই ১১ বছর বয়সী সৈকত সরকারও। ভাইয়ের কাজ দেখতে দেখতে সেও হয়ে ওঠে এই যুদ্ধের আরেক সহযোদ্ধা। এখন দুই ভাই মিলে থ্রিডি অ্যানিমেশন ও প্রোডাক্ট অ্যানিমেশনের মতো জটিল কাজ সামলায়। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করে তারা গড়ে তুলেছে নিজেদের ডিজিটাল এজেন্সি ‘পিক্সিহেক্স’। দুই ভাইয়ের সম্মিলিত মাসিক আয় এখন ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা। তাদের এই প্রতিষ্ঠানে কর্মী যুক্ত হয়েছে আরও চারজন।

সৈকত জানায়, ‘ভাইয়া যখন ঘুমায়, তখন আমি তার দেখানো কাজগুলো করে দিই।’ এভাবেই দুই ভাই মিলে নিজেদের পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার চিকিৎসার খরচ জুগিয়ে যাচ্ছে।

বাবা দিবসের নতুন তাৎপর্য

বাবা রুবেল মিয়া এখন প্রায় সুস্থ। তিনি বলেন, আমার বাবা দিবস প্রতিদিনই হয়। করোনার সময় আমার ছোট ছোট দুই ছেলে আমাকে বাঁচানোর জন্য দিন-রাত যে যুদ্ধ করেছে, তা ভুলতে পারি না। তিনি আরও যোগ করেন, তিনি নিজে তার বাবার জন্য যা করতে পেরেছেন, দুই ছেলে তার নিজের জন্য এর দশ গুণ বেশি করছে। সন্তানদের আয়েই এখন তিনি নিয়মিত চিকিৎসা পাচ্ছেন। পাশাপাশি স্বপ্ন দেখছেন বিদেশে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার।

মা সুলতানা রাজিয়া সেই কঠিন সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, শুভর বাবার ক্যানসার ধরা পড়ার পর কাছের মানুষরাও দূরে চলে গিয়েছিল। ফোন ধরত না, যদি টাকা চেয়ে বসি। সেই সময়ে দুই ছেলে আমাদের সাহস দিত, “মা কিছু হবে না। আমরা আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ
এই সংগ্রামের মাঝেও থেমে থাকেনি তাদের পড়াশোনা। শুভ সরকার বর্তমানে ঢাকার শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে গ্রাফিক্স ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া নিয়ে পড়ছেন এবং সৈকত সরকার আজিমপুরের রায়হান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।

বাবাকে বাঁচানোর যুদ্ধ করতে গিয়ে শুভ ও সৈকত আজ সফল। তাদের এই অদম্য ইচ্ছাশক্তি, ভালোবাসা এবং সংগ্রামের কাহিনি এখন শুধু নিজেদের পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ‘সুখবর বাংলাদেশ’ বইয়ের মাধ্যমে তাদের গল্পটি ছড়িয়ে পড়েছে হাজারো মানুষের কাছে, যা নতুন প্রজন্মের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

বইটির লেখক রাহিতুল ইসলাম বলেন, ‘সুখবর বাংলাদেশ’ শুধু একটি বই নয়, এটি একটি সাহসী সময়ের দলিল- যেখানে প্রযুক্তি, প্রতিভা ও প্রত্যয়ের গল্প রয়েছে পাশাপাশি। এটি প্রত্যেক পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে, জাগিয়ে তুলবে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন। শুধু শুভর গল্পই নয়, বইয়ের ২৫টি গল্পই পাঠককে ধরে রাখবে।

সুখবর বাংলাদেশ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি। মুদ্রিত মূল্য ৩৫০ টাকা। বইটি পাওয়া যাচ্ছে প্রথমার আউটলেটগুলোসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের দোকানে। অনলাইনে বইটি প্রথমা ডটকম ও রকমারি ডটকমে পাওয়া যাচ্ছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *