বিদেশি পর্যটকের সাড়া কম পাঁচ কারণে

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

বিশ্বের যে কোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করার মতো সব আকর্ষণীয় উপাদান আছে বাংলাদেশে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আকর্ষণ করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। পর্যটকদের মানসম্মত সেবা ও অবকাঠামো সমস্যা, ভিসা জটিলতা ও হয়রানি, প্রচার-প্রচারণা কম, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা ও যোগাযোগের মানে অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকায় বিদেশি পর্যটকদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে প্রত্যাশিত হারে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে ‘টেকসই উন্নয়নে পর্যটন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ দেশে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস।

জানা যায়, দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে প্রতিবছর ভ্রমণ করছেন প্রায় তিন কোটি পর্যটক। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক চার থেকে পাঁচ শতাংশ। দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান মাত্র চার শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ১০ শতাংশের ওপরে অবদান রাখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১শ কোটির বেশি পর্যটক প্রতিবছর ভ্রমণ করে থাকেন। সামনে এ পর্যটকের সংখ্যা দেড়শ কোটি হবে বলে ধারণা করছেন পর্যটক বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক এসেছেন ৬ লাখ ৬০ হাজার। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৫৫ হাজার। ২০২২ সালে ছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার। ২০২১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন, ২০২০ সালে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন, ২০১৯ সালে ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন এবং ২০১৮ সালে তা ছিল ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন।

এ হিসাব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছর বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আশানুরূপ বাড়ছে না। অথচ প্রকৃতির বহুরূপী সৌন্দর্যে ভরপুর এ দেশে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকা অনেকটাই পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ‘দেউলিয়া’ হয়ে পড়া শ্রীলংকা পর্যটনের ওপর ভর করে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দেশের পর্যটন স্থানগুলোতে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা কম। অনলাইন বা ইলেকট্রনিক ভিসা সুবিধা দেওয়া গেলে বিদেশি পর্যটকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করা যেত। সেই সঙ্গে পর্যটন স্থানগুলোর সঠিক প্রচারণার অভাব রয়েছে। বিদেশে সুন্দরবন, কক্সবাজারসহ বিশেষ পর্যটন এলাকা, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং ধর্মীয় তীর্থস্থানগুলোর প্রচারণা বাড়ানো গেলে ভ্রমণপিপাসুদের আগমন বাড়বে। বিদেশি পর্যটক কমে যাওয়ার পেছনে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতারও একটা বড় প্রভাব রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে গেলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি পর্যটক উভয়ই বাড়বে।

এদিকে পর্যটক ভিসা নিয়ে যারা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের বেশির ভাগই ব্যবসায়িক কাজ, উন্নয়ন সংস্থা ও দূতাবাসসংশ্লিষ্ট কাজে আসছেন। তাদের মধ্যে ভ্রমণের উদ্দেশে আসছেন মাত্র পাঁচ শতাংশ। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এশিয়া হবে পর্যটকদের গন্তব্য। তখন পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যটক ভ্রমণ করবে এশিয়া মহাদেশে। জানা যায়, বর্তমানে মোট কর্মসংস্থানের ৯.৯ শতাংশ তৈরি হয় পর্যটন খাতে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশের (আটাব) সদ্য সাবেক মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ যুগান্তরকে বলেন, সরকার ট্যুরিজম শিল্পকে বেশি গুরুত্ব দেয় না। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান খুবই নগণ্য। পর্যটন খাতের ৯৫ ভাগ প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট মালিকাধীন। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের প্রচার নেই বিদেশে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না সম্ভাবনাময় এই খাতটি। সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে আয় করেছিল ৪৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালে এই আয় কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ কোটি ডলারে। এক বছরে পর্যটন খাতে বিদেশি পর্যটকদের খরচ কমেছে ১ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন ভারতে। তার পরের অবস্থান মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার।

ট্যুরিস্ট পুলিশ ময়মনসিংহ রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক যুগান্তরকে বলেন, ২০১৩ সালে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ শুরু করার পর পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। বর্তমানে ১৪ শতাধিক ট্যুরিস্ট পুলিশ দেশের ১০৪টি পর্যটন স্পটে কাজ করছে।

পর্যটন সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট ১ হাজার ৬০৮টি ট্যুরিস্ট স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। আকর্ষণীয় পর্যটন খাতে যেসব উপাদান থাকা দরকার যেমন-সমুদ্র, নদী, বন, পাহাড়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঋতুবৈচিত্র্য সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান। বাংলাদেশে নদী রয়েছে ৩১০টি। রয়েছে অসংখ্য হাওড়-বাঁওড়-বিল। আছে সুবিশাল সমুদ্রতট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামশাদ নওরীন যুগান্তরকে বলেন, বিদেশি পর্যটকদের বেশির ভাগ ব্যবসায়িক বা পারিবারিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন। ফলে বিনোদনপিপাসু বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কম। অর্থবছরের বাজেটে পর্যটন খাতে বরাদ্দ প্রচুর হলেও প্রত্যাশিত উৎকর্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। কারণ অবকাঠামো, নিরাপত্তা ও পরিকল্পনায় দুর্বলতা রয়ে গেছে। সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আকর্ষণের ক্ষেত্রেও আয় কমে গেছে। বিদেশি টেলিভিশন, ম্যাগাজিন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে।

পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত সেবাদানে দক্ষতার অভাব, হোটেল ভাড়া, খাবারে পর্যটকদের অতিরিক্ত খরচসহ দুর্বল ব্যবস্থাপনা, আকর্ষণ করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা না থাকায় পশ্চিমা পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ব অনুমতি পেতে বিলম্বের কারণও অন্যতম। পিএটিএ প্রকাশিত তথ্য ছকে আমাদের আশপাশের সব দেশের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাংলাদেশের কোনো তথ্য সেখানে নেই। সরকার নানা পরিকল্পনা নিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা, পরিসংখ্যান ও প্রশিক্ষণ) মো. জিয়াউল হক হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, দেশের ৩০ লাখ মানুষ পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। ডমেস্টিক ট্যুরিজম যত বেশি শক্তিশালী হবে, তত বেশি বিদেশি পর্যটক আসবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানুষ নিরাপদে ও আরামদায়কভাবে যাতায়াত করতে পারে, সেই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষ্যে নানা আয়োজন : বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ দিবসটি পালিত হবে। বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পর্যটন করপোরেশন ও ট্যুরিজম বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থা দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন। সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে।

বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষ্যে সকাল সাড়ে ৯টায় আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সামনের সড়কে শোভাযাত্রা হবে। এছাড়া আলাদাভাবে প্রায় ২০০ জন সাইক্লিস্টকে নিয়ে একটি সাইকেল র‌্যালি আয়োজন করা হবে। সকাল সাড়ে ১১টায় পর্যটন ভবনে দিবসটির প্রতিপাদ্যের ওপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *