বিদেশের মাটিতে চীনের নিরাপত্তা সংস্থা : বিনিয়োগ রক্ষায় নতুন কৌশল?

Google Alert – আর্মি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দক্ষতার মধ্য দিয়ে চীন তার ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। অবকাঠামো, জ্বালানি ও যোগাযোগের মতো কৌশলগত করিডোরজুড়ে তাদের বিস্তার যতই বাড়ছে, ততই চীনা প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা ঝুঁকিও বেড়ে চলেছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), যা একসময় পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, এখন ক্রমেই এমন সব অঞ্চলে প্রবেশ করছে যেখানে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে টানাপোড়েন। এমন পরিস্থিতিতে চীন এক অপ্রচলিত হাতিয়ারের ওপর নির্ভর করছে- প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি বা বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী।

এই কোম্পানিগুলোর ভূমিকা একসময় কেবল প্রকল্প এলাকা পাহারা দেয়া বা প্রকৌশলীদের পাহারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন তারা চীনের বহির্বিশ্ব নিরাপত্তা কৌশলের একটি নতুন স্তরে পরিণত হয়েছে, যেখানে তারা চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির চেয়ে কম দৃশ্যমান, কূটনৈতিক ব্যাখ্যার বাইরে, এবং প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের তুলনায় অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে নমনীয়। তারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ছদ্মবেশে কাজ করলেও বাস্তবে এগুলো চীনের বিনিয়োগ রক্ষায় কৌশলগত হাতিয়ার।

চীনা স্বার্থ সম্প্রসারণ

মিয়ানমার এই প্রসঙ্গে একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। রাখাইন রাজ্যের কিয়াকফিউতে চীনা তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তায় এতদিন এসব নিরাপত্তা কোম্পানি সীমিত ভূমিকা রাখলেও, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেখানে ৫০ থেকে ১০০ জন অতিরিক্ত চীনা নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর আগে অবকাঠামোগত কাজের জন্য অঞ্চলটিতে চীন ৩০০ জনেরও বেশি শ্রমিক পাঠিয়েছিল। তবে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এসব নিরাপত্তাকর্মী শুধু অবকাঠামোর সুরক্ষায় নয়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে ড্রোন অপারেশন ও স্নাইপার মিশনে সহায়তাও করছে। এ যেন নিরাপত্তা থেকে সরাসরি সংঘাতে অংশগ্রহণের এক রূপান্তর।

এদিকে, জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) কিয়াকফিউ শহরের মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গেছে। শহরটি রাখাইনের তিনটি শহরের মধ্যে একটি, যা এখনো জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিদ্রোহীরা কিয়াকফিউ ও মেড আইল্যান্ড সংযুক্ত রাস্তাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবস্থান দখল করেছে, যেখানে চীনা অর্থায়নে নির্মিত গভীর সমুদ্র বন্দর ও পাইপলাইন প্রকল্প রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ওই এলাকায় জেট ফাইটার, চীনের তৈরি ড্রোন ও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে এবং কয়েক মাসব্যাপী লড়াই হয়েছে।

চীনের কাছে কিয়াকফিউ পাইপলাইন শুধু একটি অর্থনৈতিক প্রকল্প নয়, বরং এটি ভারত মহাসাগরের সাথে সরাসরি জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং মালাক্কা প্রণালীর ওপর চীনের নির্ভরতা কমিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই চীনা কৌশলবিদরা একে দুর্বলতা হিসেবে দেখতেন। মিয়ানমারের উত্তরে চলমান অস্থিতিশীলতা এই করিডোরের জন্য সরাসরি হুমকি। চীনের জন্য এই ধরনের অবকাঠামোগত ক্ষতি শুধু আর্থিক নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক প্রভাব ও বিআরআই-এর বিশ্বাসযোগ্যতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।

চীনে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ব্যবহার যে বিষয়টিকে আলাদা করে তোলে তা হলো রাষ্ট্র ও বাজারের মধ্যে অস্পষ্ট সীমানা। যদিও এগুলো বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত, ডিউই সিকিউরিটি বা ফ্রন্টিয়ার সার্ভিসেস গ্রুপের মতো অনেক সংস্থাই পিএলএ’র সাবেক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এবং চীনের নিরাপত্তা কাঠামোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। এদের কার্যক্রম কেবল বাজারের প্রয়োজনে নয়, বরং রাষ্ট্রের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। এই সংস্থাগুলো একটি ধূসর অঞ্চলের মধ্যে কাজ করে, যেখানে তাদের ভূমিকা কখনো সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নয় অথবা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতও নয়, কিন্তু সর্বদা রাজনৈতিকভাবে কার্যকর।

কৌশলগত ঝুঁকি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বেসরকারি বাহিনীগুলোর রাজনৈতিক ব্যবহার যতই লাভজনক হোক না কেন, এর ঝুঁকিও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যখন কোনো দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিদেশী বাহিনী জড়িয়ে পড়ে, যাদের প্রতি জবাবদিহিতা অন্য সরকারের কাছে, তখন তা ‘রক্ষাকবচ’ থেকে ‘হস্তক্ষেপে’র দিকে মোড় নেয়। এতে করে স্থানীয় জনগণের মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে এবং চীনের ভাবমূর্তি ধ্বংস হতে পারে।

চীনের অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতা

যদি চীনের বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীরা এখন সরাসরি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সক্রিয় সহায়তামূলক ভূমিকা নিতে শুরু করে, তবে পাকিস্তান, মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ বা আফ্রিকার সংঘাতপূর্ণ এলাকায় তাদের একই ধরনের মোতায়েন শুধু সম্ভাব্য নয়, বরং প্রায় নিশ্চিত বলা যায়। অবকাঠামো রক্ষার নাম করে বিদেশী নীতিতে হস্তক্ষেপের সীমারেখা দিন দিন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর এর সাথে সাথে চীনের ‘শান্তিপূর্ণ ও কেবল বাণিজ্যনির্ভর উত্থান’-এর দাবিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

চীনা নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোর উত্থান শুরু হয়েছিল একটি যৌক্তিক প্রয়োজনে, কিন্তু তা এখন দ্রুতই একটি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে। এই রকম অবস্থান থেকে বিশ্ব এখন এক নতুন ধরনের চীনা উপস্থিতির সাক্ষী হচ্ছে, যা না উন্নয়নমূলক, না কূটনৈতিক, বরং বলপ্রয়োগনির্ভর বাণিজ্যিক। এই বেসরকারি বাহিনী শুধু পাইপলাইন পাহারা দিচ্ছে না, তারা অঞ্চলকে এক ধরনের বার্তা দিচ্ছে- চীনের বিনিয়োগ নিয়ে আপস নয়, এবং প্রয়োজনে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও বেইজিং তা রক্ষা করবে।

সূত্র : ইরাবতি

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *