The Daily Ittefaq
‘লিবিয়ায় আমাদের দিনের পর দিন বেঁধে রাখত, লোহার রড দিয়ে পেটাত। খেতে দিত না। নির্যাতনের ভিডিও আমাদের পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ নিয়েছে। মরে গেছি ভেবে শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের মরুভূমিতে ফেলে রেখে গিয়েছিল। বাংলাদেশি কয়েক জন শ্রমিক আমাদের খুঁজে পেয়েছেন। বেঁচে কোনোদিন যে দেশে ফিরতে পারব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি।’ সম্প্রতি লিবিয়া থেকে দেশে ফেরা তানজির শেখ কথাগুলো বলছিলেন। কষ্টের টাকায় বিদেশে গিয়ে টর্চার সেলে বন্দি হয়ে থাকতে হয়। দিনরাত মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। বিদেশে কাজের সুযোগ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে অজ্ঞাত জায়গায় আটকে রাখে চক্রগুলো। তারপর পরিবারের কাছে দাবি করে মুক্তিপণ। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে এমন বন্দি ১৭৬ জনকে উদ্ধার করে দেশে আনা হয়েছে।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফরম) শরিফুল হাসান ইত্তেফাককে বলেন, ‘মানুষ যে শুধু অর্থের কারণে মানুষ অবৈধপথে বিদেশে যান, তা কিন্তু না। মূল কারণ তারা আসলে দেশ ছাড়তে চান। দেশে যদি সুশাসন না থাকে, কর্মসংস্থান না থাকে তখনই মানুষ এই অবৈধ অভিবাসনে উদ্বুদ্ধ হয়। আমাদের সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তা না হলে এই সমস্যার সমাধান কোনোদিনও সমাধান হবে না।’ লিবিয়ায় মানব পাচারের শিকার হয়ে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে দীর্ঘ নয় মাস পর গত ৯ জুলাই দেশে ফিরেছেন ঝিনাইদহের মতিউর রহমান সাগর, কুষ্টিয়ার তানজির শেখ ও নোয়াখালীর আলমগীর হোসেন। তাদের সঙ্গে লিবিয়া থেকে একই ফ্লাইটে ফিরেছেন মোট ১৭৬ জন বাংলাদেশি। এদের মধ্যে বেনগাজীর গানফুদা ডিটেনশন সেন্টারে ১৪১ জন এবং ত্রিপলীর তাজুরা ডিটেনশন সেন্টারে ৩৫ জন অভিবাসী আটক ছিলেন।
দেশে ফিরে তানজিল শেখ বলেন, ২০২৩ সালে দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে ৪ লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় যান। দালালরা তাদের ইতালিতে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে লিবিয়া পাঠিয়েছিল। সেখানে পৌঁছানোর পর পাচারকারীরা তাদের ভয়ংকর এক মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ত্রিপোলিতে আরও ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় মাসের পর মাস নির্মম নির্যাতন। পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া হয় মুক্তিপণ। একসময় তারা মারা গেছেন এটা ভেবে পাচারকারীরা তাদের মরুভূমিতে ফেলে রাখে। সেখান থেকে তাদের মৃতপ্রায় অবস্থায় কয়েক জন বাংলাদেশি শ্রমিক খুঁজে পান এবং আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
বিমানবন্দরের বিদেশফেরতদের জরুরি সহায়তা দিতে গত আট বছর ধরে কাজ করছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টার। সিভিলে এভিয়েশন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এপিবিএনসহ সবার সহযোগিতায় গত আট বছরে ৩৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে নানা ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই ৪০ জন প্রবাসীকে বিশ্বের নানা দেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ইত্তেফাককে বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসনের পেছনে রয়েছে দেশি-বিদেশি এক বা একাধিক চক্র। কোনো একটি দেশের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে যে বিমানবন্দরগুলো এই কাজে ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে সম্মিলিত মনিটরিং দরকার। শুধু যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধপথে এই কাজ হচ্ছে তা কিন্তু না। আরও বেশ কিছু দেশ আছে এই তালিকায়। ৮০ বা ৯০-এর দশকে এভাবে হয়তো কিছু মানুষ ইতালি গেছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এভাবে আর বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঐ দেশগুলোও সতর্ক হয়েছে। ফলে খুব বেশি মানুষ এভাবে যেতে পারেন না।’
অবৈধপথে যাওয়া ব্যক্তিদের ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি হন : ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার পথে ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি হন আর ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য বলছে, লেবানন হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে বাংলাদেশিরা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রুটে প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছে। লিবিয়া ফেরত ৫৫৭ জনের বাংলাদেশির তথ্য বিশ্লেষণ করে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলেছে, তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায়। যাদের ৮৯ শতাংশই নানা ঝুঁকিতে পড়েছেন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নযাত্রা যেন মৃত্যুযাত্রায় পরিণত না হয়, তার জন্য সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি এই সংকট কাটাতে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন।
৭০ লাখ টাকায় ফিরল পরিবারের কাছে :ইতালি যাওয়ার হাতছানিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশ ছেড়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের রিপন শিকদার ও গাজীপুরের মাসুম মোল্লা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইউরোপের দুয়ার পেরোনোর আগেই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে পাচার হন লেবাননে। ক্যাম্পে বন্দি রেখে শুরু হয় দুঃসহ নির্যাতন। জিম্মি করে, নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে আদায় করা হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। দিনের পর দিন প্রতারক চক্রকে প্রায় ৭০ লাখ টাকা দিয়েও নির্যাতন থেকে নিস্তার মেলেনি। অবশেষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা—আইওএমের যৌথ উদ্যোগে মুক্তি পান এই দুই ভুক্তভোগী।
লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে গত ২১ জুন বাংলাদেশে পৌঁছান তারা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন দুই ভুক্তভোগী। তাদের অভিযোগ, দালাল চক্রের প্রধান মোজাম্মেল, নওশাদ, নজরুল, সোহাগ ও হাওলাদার ট্রাভেলস কোম্পানি এ ঘটনার মূল হোতা। রিপন শিকদার বলেন, ‘ক্যাম্পে নিছে ওখান থেকে মার শুরু করছে। খাবার দেয় না, খাবারের জন্য আমরা বলতাম ভাই একটু খাবার দেন, খাবার দিত না। কান্না করতাম, কান্না করে অনেক সময় আব্বাকে বলতাম যে, আব্বা আমার জানটা একটু ভিক্ষা দেন আপনি। আবার বাপের এখন কিছু নাই। আমার জন্য সব বিক্রি করে দিছে।’ মাসুম মোল্লা বলেন, ‘আমি অনেক দিন নিখোঁজ ছিলাম। আমাদের পরিবার জানে না আমরা বেঁচে আছি, না মরে গেছি। অবশেষে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু নির্মমতায় হাঁপিয়ে ওঠা জীবন থেকে মুক্তি মিললেও মানসিকভাবে দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় সব সময়।’
ইতালি, গ্রিস ও সাইপ্রাস থেকে ফিরল ২৯ জন :অবৈধভাবে অবস্থান এবং অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতালি, গ্রিস ও সাইপ্রাস থেকে বিতাড়িত ২৯ জন বাংলাদেশিকে তিন দিন আগে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। প্রত্যাবর্তনকারীদের মধ্যে ১৬ জন ইতালি থেকে, ৯ জন গ্রিস থেকে এবং চার জন সাইপ্রাস থেকে এসেছেন। তাদের কারো কাছেই এই দেশগুলোতে থাকার বৈধ কাগজপত্র ছিল না বলে অভিবাসন সূত্র জানিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুসারে, এই তিনটি দেশ থেকে আরও ১৩ জন বাংলাদেশিকে বিতাড়িত করা হবে। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে দোহারের হাসান খানও ছিলেন, যিনি পাঁচ বছর আগে গ্রিসে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভূমধ্যসাগর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার জন্য দালালদের কাছে সাড়ে ১০ লাখ টাকা খরচ করেছিলাম। সবে মাত্র ঋণ পরিশোধ করতে পেরেছি এবং এখন আমার দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’
সরকারি তথ্য অনুসারে, গত দেড় বছরে আমেরিকা, লিবিয়া এবং এখন ইউরোপ থেকে শত শত বাংলাদেশিকে বিতাড়িত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ১৮৭ জন বাংলাদেশিকে আমেরিকা থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। গত ২ আগস্ট একটি মার্কিন সি-১৭ সামরিক বিমান ৩৯ জন বাংলাদেশিকে বিতাড়িত করেছে, যার মধ্যে এক জন মহিলাও রয়েছেন। গত ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ জনকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, যেখানে ৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিলের মধ্যে একাধিক ফ্লাইটে আরও ৩৪ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। গত ২১ আগস্ট ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ার পর ১৭৬ জনকে লিবিয়া থেকে ফেরত আনা হয়।
স্বপ্নের ইউরোপের প্রবেশের পথ :বৈধপথে যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশী কাজের সন্ধানে ইতালি যেতে পারেন না, তাদের একমাত্র ভরসা আন্তর্জাতিক আদম পাচারকারী ও তাদের সহযোগী দালাল। এসব পাচারকারীর সহায়তায় বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে বিদেশগামীদের নেওয়া হয় দুবাই। দুবাই থেকে তাদের পাঠানো হয় তুরস্ক বা মিসর। দালালরা সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয় লিবিয়ায়, পরে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে যায় ইতালি।
লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে জনপ্রিয় ও বিপজ্জনক তিনটি ধাপ আছে। লিবিয়ায় যাওয়ার পর দালালদের মাধ্যমে তাদের একটি দলে ঢোকানো হয়। পরে তাদের সাগরে কম্পাস (দিক নির্ণয়ের যন্ত্র) ধরে পথ চেনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় লিবিয়ার জোয়ারা ও তাজোরা উপকূল থেকে। যাত্রা শুরুর পর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই নৌকা চালাতে শুরু করেন। দালালরা তখন সঙ্গে থাকে না। ভূমধ্যসাগরে নৌকা ছাড়ার পর ভাগ্যাহত এসব অভিবাসীর দায়িত্বও কেউ নেয় না। তখন একমাত্র ভরসা ভাগ্যবিধাতা।
পরে অভিবাসীদের সমুদ্রপথে নেওয়া হয় ইতালির সিসিলি দ্বীপে। কিন্তু কয়েক দিনের প্রশিক্ষণে সাগরে ঠিকভাবে দিক নির্ণয় করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে অনেক সময় ভুল করে নৌকা চলে যায় ভূমধ্যসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে লিবিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়। অনেকে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশিতে কম্পাস দিয়ে দিক নির্ণয় করতে না পারায় ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যান বা সলিলসমাধি হয়। অনেক সময় এই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংশ্লিষ্ট কোস্ট গার্ড সদস্যরা লিবিয়া বা তিউনিসিয়া বন্দরে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ঠিকানা হয় অন্ধকার কারাগার।