বিশ্ব অর্থনীতির রক্ষক হতে পারবে এশিয়া ও ইউরোপ?

Google Alert – সামরিক

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা দেশ অনেকটা একই ধরনের অভিঘাতের মুখোমুখি হচ্ছে। অস্থির মার্কিন শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ক্রমাগত ভাঙন এখন মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক সংঘাত থেকে বাণিজ্য পথ ও জ্বালানি তেল উত্তোলনে বিঘ্ন ঝুঁকির তালিকায় যুক্ত হয়েছে।

তাছাড়া ডলারনির্ভর সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বিগ, বিউটিফুল’ ব্যয় বিল এরই মধ্যে দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থানকে আরো ক্ষয় করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সময়ে ভূরাজনৈতিক কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যাপক পুনর্বিন্যাস চলছে এবং জলবায়ু ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে এখন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র আবারো প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসেছে।

যেহেতু সবাই এ ধাক্কাগুলোর শিকার হবে, তাই এগুলো কমানোর জন্য সহযোগিতা একটি অগ্রাধিকার ইস্যু হওয়া উচিত। বিশেষ করে এশিয়া ও ইউরোপের জন্য। উভয় অঞ্চলই বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত এবং উভয়ই মার্কিন আর্থিক নির্ভরযোগ্যতা হারানোর কারণে প্রভাবিত হতে পারে। অনেক এশীয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডলার-সম্পদে ভারিভাবে নির্ভরশীল এবং তাদের বেশির ভাগ বৈদেশিক বাণিজ্য ডলারে বিল করা হয়। একইভাবে জলবায়ু পরিবর্তন সব দেশের জন্য একটি বড় হুমকি। তবে ইউরোপ বিশেষ করে তার ভবিষ্যৎ পরিচ্ছন্ন-জ্বালানি রূপান্তরের ওপর নির্ভর করে আছে।

সহজ কথায়, সাম্প্রতিক ধাক্কাগুলো এশিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক মডেলগুলোর ভিত্তি মুক্ত বাণিজ্য, যা নিজেই একটি নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত—তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র নীতিপ্রণেতা থেকে নীতি লঙ্ঘনকারীতে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্পের বিভ্রান্তিকরভাবে পারস্পরিক শুল্ক হিসেবে আখ্যায়িত নীতি স্পষ্টভাবে মোস্ট-ফেভারড-নেশন (এমএফএন) নীতি লঙ্ঘন করে, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কোনো সদস্যকে আনুষ্ঠানিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ছাড়া বিভিন্ন দেশের জন্য ভিন্ন বাণিজ্য বাধা বজায় রাখতে নিষেধ করে। ট্রাম্প ডব্লিউটিওর বাউন্ড রেটের বাইরে তার শুল্কের হার না বাড়ানোর মার্কিন অঙ্গীকারও লঙ্ঘন করেছেন, যা বৈশ্বিক ব্যবস্থার আরেকটি ভিত্তিপ্রস্তর।

একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ডলারকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে, যার ওপর এশিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলো দীর্ঘকাল ধরে তারল্য, বাণিজ্য অর্থায়ন ও আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভর করে এসেছে। মার্কিন আর্থিক অবস্থানের প্রত্যাশিত ক্ষয়, ট্রাম্পের অস্থির শুল্কনীতির সঙ্গে মিলিত হয়ে ডলারের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে।

নির্দলীয় কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের মতে, কংগ্রেসে ট্রাম্প যে বাজেট বিল পাস করাতে চান, তা যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণের (২০২৪ সালে মার্কিন জিডিপির প্রায় ১০০ শতাংশ) সঙ্গে আরো ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করবে এবং কংগ্রেসনাল রিপাবলিকানরা আরো ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ সীমা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, ফলে ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার সময় মার্কিন ফেডারেল সরকারের ঋণ জিডিপির ১৩৪ শতাংশে পৌঁছতে পারে।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত উক্তি ছিল, দেউলিয়াত্ব ধীরে ধীরে ঘটে এবং তার পরে হঠাৎ করে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কখনো টেকনিক্যালি খেলাপি হয়নি, তাই সরকারি বন্ডে ঝুঁকির প্রিমিয়ামের সাম্প্রতিক বৃদ্ধিকে ‘ধীরে ধীরে’ পর্বের মধ্যে পড়ে বলে মনে করা যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের এখন ‘হঠাৎ’ আগের ধারণার চেয়ে তাড়াতাড়ি আসার সম্ভাবনা বিবেচনা করতে হবে।

পৃথক হেজিং কৌশল খোঁজার পরিবর্তে এশিয়া ও ইউরোপের সহযোগিতা থেকে বেশি উপকৃত হবে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দুটি বৃহৎ এশীয় বাণিজ্য ব্লক, আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব (আরসিইপি) এবং ব্যাপক ও প্রগতিশীল ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারত্ব চুক্তির (সিপিটিপিপি) মধ্যে একটি উন্নত কাঠামো স্থাপন করলে প্রায় পুরো বিশ্বের জন্য বাণিজ্য নিয়ম তৈরি হবে; যুক্তরাষ্ট্র যা-ই করুক না কেন।

একটি সফল কাঠামোর মূল চাবিকাঠি হবে ডব্লিউটিওর সব নিয়ম বজায় রাখা, যা সাত দশক ধরে বাণিজ্য ও সমৃদ্ধি চালনায় কার্যকর প্রমাণ হয়েছে, যার মধ্যে এমএফএন নীতিও রয়েছে। তবে এশীয় ও ইউরোপীয় নেতাদের ডব্লিউটিওর ত্রুটিপূর্ণ নিয়মগুলোও উন্নত করতে সচেষ্ট হতে হবে, যার মধ্যে ভর্তুকি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর আচরণসংক্রান্ত নিয়মাবলিও রয়েছে। তাদের ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকেও পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, সম্ভবত আপিল বোর্ডের বিচারকের সংখ্যা তিন গুণ করে।

জলবায়ু ফ্রন্টে বিপদ এখন এই যে অন্যান্য দেশ (যেমন আর্জেন্টিনা) প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করতে পারে। এ সম্ভাবনা এড়াতে এশিয়া ও ইউরোপের একটি সাধারণ কার্বন-শুল্ক কাঠামো অনুসরণ করা উচিত। যদি বিশ্বের দুটি বৃহত্তম বাণিজ্য অঞ্চল কার্বন-নিবিড় আমদানির ওপর একই জরিমানা আরোপ করে, তবে তারা ডিকার্বনাইজেশনের পথে থাকার জন্য একটি শক্তিশালী প্রণোদনা তৈরি করবে।

আন্তর্জাতিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে দুটি অঞ্চল এমন একটি ব্যবস্থার দিকে কাজ করতে পারে, যা যেকোনো একক দেশের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের প্রতি আরো স্থিতিস্থাপক। লক্ষ্য মার্কিন ডলারকে প্রভাবশালী বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিস্থাপন করা নয়, বরং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও বৈচিত্র্যকরণে আরো উপকরণ সরবরাহ করা।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি নতুন স্থিতিশীল মুদ্রা ইউরো বা প্রধান এশীয় মুদ্রাগুলোর মধ্যে একটির সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলারের বাইরে স্বাধীন মুদ্রা-বিনিময় চুক্তিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক গঠন করতে পারে এবং দেশগুলো ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সার্বভৌম ঋণদাতাদের প্যারিস ক্লাবের মধ্যে সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি আরো শক্তিশালী বহুপক্ষীয় ঋণ-ত্রাণ কাঠামোর দিকে কাজ করতে পারে।

অবশ্যই প্রতিটি আঞ্চলিক ব্লকের দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উত্তেজনা থাকায় এ সমাধানগুলোর কোনোটিই সহজে অর্জন করা যাবে না। সহযোগিতার জন্য বিভাজন প্রয়োজন হবে, যেখানে সরকারগুলো সরাসরি বৈশ্বিক জনকল্যাণমূলক পণ্য সরবরাহের দিকে মনোনিবেশ করবে। এটি যত চ্যালেঞ্জিং মনে হোক না কেন, এর বিকল্প এশিয়া ও ইউরোপ এবং বিশ্বের বাকি অংশের জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল হবে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

শাং-জিন ওয়েই: এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স ও অর্থনীতির অধ্যাপক

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *