বৈদেশিক সম্পর্কে কতদূর অগ্রসর হলো বাংলাদেশ

Google Alert – ইউনূস

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ সময়ে বৈদেশিক সম্পর্কে কিছুটা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। শক্তিশালী বড় বড় বৈদেশিক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে এর বড় ধরনের প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে।

বিগত এক বছরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ আচরণ, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে দুবার রদবদল করতে হয়েছে সরকারকে, যা কিছুটা বিব্রতকরও ছিল।

কূটনৈতিক মহলের অভিজ্ঞরা বলছেন, গত এক বছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতদূর অগ্রসর হয়েছে, এর একটি বড় কারণ বিশ্বব্যাপী প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও ইতিবাচক ভাবমূর্তি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক কেমন, সেটা নির্ভর করে বা বোঝা যায়, দুটি দেশের রাজনৈতিক

নেতৃত্বের বোঝাপড়ার ওপর। যেমন- আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের বোঝাপড়া অত্যন্ত ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সঙ্গে সেটির অভাব আছে। তারপরও প্রধান উপদেষ্টার নিজস্ব ভাবমূর্তি ও সুনামের কারণে অনেক জায়গায় বাংলাদেশ বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়েছে।’

এক বছরে যোগাযোগ

গত এক বছরে বড় ধরনের বৈদেশিক সম্পৃক্ততার মধ্যে রয়েছে ২০২৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নিউ ইয়র্কে বৈঠক। এর পাশাপাশি মুহাম্মদ ইউনূসের চীন ও জাপান সফর এবং শীর্ষ নেতারে সঙ্গে বৈঠক। বিদেশ সফর ছাড়াও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ও জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ঢাকা সফর করেছেন। চলতি আগস্টে মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়ায় সফর এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের কথা রয়েছে।

সাবেক একজন কূটনীতিক এ বিষয়ে বলেন, ‘২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কোনও ধরনের দ্বিপক্ষীয় সফর হয়নি। তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন দেশে গেছেন। কিন্তু সেগুলো ছিল বহুপাক্ষিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস না হয়ে অন্য কেউ হলে- এই সরকারের সময়ে যে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ হয়েছে, সেটি হতো না কিনা সন্দেহ আছে।’

গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অংশীদার

রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো হচ্ছে- ভারত, চীন, জাপান, ব্রাসেলস (ইইউ-এর সদর দফতর) এবং যুক্তরাষ্ট্র। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের সঙ্গে গত এক বছরে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। বাকিদের সঙ্গে সম্পর্ক ভিন্ন হওয়ার শঙ্কা আছে।

ভারত: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সোনালি অধ্যায় ছিল দুই দেশের মধ্যে। কিন্তু সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ রোগী চিকিৎসা করাতে ভারত যেতো, কিংবা শিক্ষার্থী ও অন্যান্য পর্যটক যেতো- সেই সংখ্যা তলানিতে নেমে আসে। এর ফলে মেডিক্যাল পর্যটকরা এখন ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা অন্য দেশে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে- অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের অনীহা আছে।

চীন: ভারতের অনীহার পূর্ণ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে বেইজিং। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সে দেশে সফরের আমন্ত্রণ জানায় চীন সরকার। বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হয় প্রধান উপদেষ্টার। শুধু সরকার নয়, চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে। বাংলাদেশে তারা বড় বিনিয়োগের আগ্রহ দেখালেও এখনও পর্যন্ত সেটি আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে।

জাপান: জাপান সরকারের আমন্ত্রণে টোকিও সফর করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে তার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের যে প্রতিশ্রুতি ছিল- তা অব্যাহত রাখার বিষয়ে জাপান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে, নতুন কোনও বড় সম্পৃক্ততায় যুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি নেই।

ব্রাসেলস: ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদর দফতর ব্রাসেলস এবং ইইউ’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে লিখিতভাবে তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা সম্পর্কিত একটি চুক্তি ‘পার্টনারশিপ অ্যান্ড কোঅপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (পিসিএ)’ নিয়েও আলোচনা চলছে। চলতি বছরের মধ্যে চুক্তির প্রাথমিক আলোচনা শেষ হওয়ার কথা।

যুক্তরাষ্ট্র: গত বছর প্রধান উপদেষ্টার নিউ ইয়র্ক সফরের সময়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। কিন্তু জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর ওই আন্তরিকতায় কিছুটা ভাটা পরিলক্ষিত হয়। শুধু তাই নয়, গত এপ্রিলে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ নিয়ে দুপক্ষের মাঝে আলোচনা এখনও চলছে।

ভবিষ্য চ্যালেঞ্জ

সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর একটি হলো, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অপরটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনার ফলাফলের প্রভাব।

২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনও কোনও ফলাফল পাওয়া যায়নি। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনার ফলাফলের প্রভাব বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ওপরে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই চুক্তির বিষয়টি যদিও অন্য দেশগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এই ফলাফলের ওপর তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ভর করতে পারে।

এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ নীতি অর্জনের ক্ষেত্রে যে বৈদেশিক সহায়তা প্রয়োজন, সেটি অর্জনের জন্য পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করা হয়। যেকোনও সরকারকে আগে তার অভ্যন্তরীণ নীতি ঠিক করতে হবে এবং তার ওপর ভিত্তি করে পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করা হয়।’

বাংলাদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ নীতি কিছুটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশিদের কাছে আমরা কী চাই, সেটি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য সুষ্ঠু অভ্যন্তরীণ নীতিমালা থাকা দরকার।’

আরেকজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য যারা প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন, তারা এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় বলে প্রতীয়মান হয়। অপরদিকে নন-স্টেট অ্যাক্টর- যারা সরকারের মধ্যে নেই, তারা অনেক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ে, অথবা বিভিন্ন ধরনের পররাষ্ট্রনীতি ও সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা অনেক সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিব্রত করে থাকে। এর প্রভাব পড়ে তাদের সামগ্রিক কার্যক্রমে, বলে তিনি জানান।

তিনি আরও বলেন, ‘সুষ্ঠু পরিবেশে পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের মনে হয় একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

 

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *