CHT NEWS
সমর, সোহেল, রোনাল
অতীতের বহু বিস্মৃত ঘটনাবলীর মাঝে পার্বত্য
চট্টগ্রামের জনগণ গর্বের সাথে স্মরণ করতে পারে এমন একটি ঘটনা হচ্ছে, ব্রিটিশ আগ্রাসনের
বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ (১৭৭২-১৭৯৮)। ‘সিপাহী যুদ্ধের’ (১৮৫৭) বহু আগে তা সংঘটিত হয়।
এটি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয় বলতে গেলে, এ অঞ্চলের তথা দক্ষিণ এশিয়ার মুক্তিকামী
মানুষের লড়াই সংগ্রামে এ ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে।
বাংলাপেডিয়ার প্রণেতা ঐতিহাসিক সিরাজুল ইসলাম
(বাংলাদেশের ইতিহাস), পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত বামপন্থী লেখক সুপ্রকাশ রায় (ভারতে কৃষক
বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম), রতন লাল সেন, সুনীতি ভূষণ কানুনগোসহ (Chakma
Resistance to British Domination) যে ক’জন অনুসন্ধিৎসু
এ বিষয়ে লেখা-লেখি করেছেন, প্রত্যেকেই এ ঘটনার উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন। তখনকার ‘পার্বত্য
চট্টগ্রাম’ আজকের মতো এত দৈন্যদশাগ্রস্ত ছিল না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের
এক্তিয়ার বহির্ভূত এটি ছিল এক স্বাধীন ‘পার্বত্য রাজ্য’।
প্রতীকী ছবি (সংগৃহিত)। |
উপমহাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ‘চট্টগ্রামের’
কর্তৃত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে গেলে, পার্শ্ববর্তী ‘পার্বত্য রাজ্যে’র ওপরও
তার বড় ধাক্কা লাগে। আগে ‘পার্বত্য রাজ্যের’ রাজারা চটগ্রামস্থ মুঘল প্রতিনিধিকে ব্যবসায়িক
বন্দোবস্ত অনুসারে (সমতলের বেপারিদের পাহাড়ে প্রবেশের অনুমোদন) যে ১১ মণ কার্পাস (তুলা)
দিত, এবার তা লাভের অধিকারী হয় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। নিজেরা সরাসরি আদায় না করে ব্রিটিশরা
মধ্যসত্ত্বভোগী স্থানীয় বাঙালি বেপারি-ঠিকাদার (ফড়িয়া-ইজারাদার)-এর মাধ্যমে উক্ত কার্পাস
সংগ্রহ করতো। কোম্পানিকে নির্ধারিত অংশ দিয়ে সংগৃহীত কার্পাসের বাদ বাকি অংশ বেপারিরা
নিজেরা আত্মসাৎ করতো, তাতে কোম্পানিরও সায় ছিল। ফলে অত্যধিক মুনাফার লোভে বেপারিরা
সাধারণ জুম চাষীদের থেকে বাড়তি কার্পাস আদায়ের পথ অবলম্বন করে। ব্যবসায়িক চাতুরি ফন্দির
মাধ্যমে আবার কখনও জবরদস্তি করেও জুম চাষিদের কাছ থেকে উৎপাদিত তুলার বেশির ভাগ অংশ
আদায় করে নিতো, তাদের একেবারে নিঃস্ব করে ফেলতো। ইজারাদার-বেপারিদের দেয়ার পর জুম চাষীর
ভাগে যে যৎসামান্য তুলা থাকত, তা দিয়ে তাদের সমতলের হাট-বাজার থেকে লবন ও প্রয়োজনীয়
সামগ্রী সংগ্রহ করার অবস্থা থাকতো না। পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও জুম চাষীরা ঠকত। ‘২ টাকা’
দামের লবন কিনতে হতো ‘৮ টাকা’ দামে (তখনকার দিনে তুলার মূল্য ছিল মণে ৮ টাকা, আর লবন
মণে ২ টাকা।) অত্যধিক মুনাফা লোভী বেপারি-ইজারাদের দাপটে সাধারণ জুমিয়াদের জীবন হয়ে
উঠেছিল দুর্বিষহ।
যতদূর জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলে প্রজা
সাধারণের এ দুঃসময়ে রুণু খাঁ’ প্রথম দিকে বেপারি-ইজারাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে তাদের
সতর্ক করেন, অবৈধ কারবার বন্ধের নির্দেশ জারি করেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন ‘রাঙ্গুনিয়ার’
গভর্নর এবং যুগপৎভাবে রাজার সেনাপতিও। কিন্তু লোভী অপরিণামদর্শি বেপারী-ইজিরাদাররা
নিজেদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শক্তির বলে বলীয়ান ভেবে তাদের শোষণ অব্যাহত রাখে, রুণু
খাঁ’র নির্দেশ মানতে গড়িমসি করে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে রুণু খাঁ বেপারি-ইজারাদারদের
শায়েস্তা করতে সৈন্যসামন্ত নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হন, ভুক্তভোগী বিক্ষুব্ধ
জনতাও এ অভিযানে যুক্ত হয়। রুণু খাঁ’র নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ জনতা-সৈন্যবাহিনী অবৈধভাবে
উত্তোলিত কার্পাস জব্দ করে, দুর্নীতিগ্রস্ত ইজারাদের গোলা পুড়িয়ে দেয়। এ অভিযানে দুষ্কৃতকারী
যে ক’জন বেপারি-ইজারাদার হাতে-নাতে ধরা পড়ে, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সাজাও হয়, আজকের দিনের
মোবাইল কোর্ট-এ সাজার মতো। অনেকে পালিয়ে কোম্পানির নিকট আশ্রয় নেয় এবং তাদের কাছে নালিশ
জানায়। চট্টগ্রামস্থ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা ‘কালেক্টর’ বেপারি-ইজারাদের
সাহায্যার্থে রাঙ্গুনিয়ায় সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে ‘দমন অভিযানে’ নামলে সংঘর্ষের সূত্রপাত
হয়, যা পরবর্তীতে গুরুতর রূপ পরিগ্রহ করে। ঔপনিবেশিক অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘পার্বত্য
রাজ্য’ ও আশেপাশের অঞ্চলের সকল জাতিগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়। বলতে গেলে ‘ভিয়েতনাম (১৯৫৫-১৯৭৫)
ও আফগানিস্তানে (২০০১-২০২১) মার্কিন আগ্রাসন প্রতিরোধের’ মতোই পার্বত্যবাসীও একটি অসম
শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা চলে দু’যুগের অধিক কাল
ধরে। ইতিহাসে তা ‘চাকমা বিদ্রোহ’ নামে খ্যাতি লাভ করলেও, এতে এ অঞ্চলের সকল জাতিগোষ্ঠী
যুক্ত ছিল।
যে কোন যুদ্ধের মতো এতে পার্বত্যবাসী যেমন
চরম ভোগান্তির মুখে পড়ে, অন্যদিকে আগ্রাসী ব্রিটিশরাও চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয়ে
গুরুতর ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু দীর্ঘকাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে নিষ্ফল
অভিযান চালিয়ে নেয়া যে আদৌ দূরদর্শিতার পরিচায়ক নয়, তা উপলদ্ধি করতে না পারার কোন কারণ
ছিল না। নিজেদের স্বার্থেই ব্রিটিশরা পরে পার্বত্য রাজাদের সাথে সমঝোতায় উপনীত হয় এবং
‘পার্বত্য রাজ্যে’র স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এর বিশদ বিবরণ বা ব্যাখ্যা দেয়া
এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
![]() |
১৫৫০ সালে পর্তুগীজ ঐতিহাসিক JOA DE BARROS এর অঙ্কিত মানচিত্র। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘চাকোমাস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। |
এখানে মূল কথা হচ্ছে, পার্বত্যবাসী অন্যায়
আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করে নি, পূর্ব পুরুষদের এই চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রতিরোধ লড়াই–
পাহাড়িদের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। যুগে যুগে তা গুরুত্বের সাথে আলোচিত হবে। পার্বত্য
চট্টগ্রামের জনগণের এমন একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় খণ্ডিত ও বিকৃত করে উপস্থাপন এবং তার
নায়কদের গালাগাল দিয়ে তাচ্ছিল্য করার অপপ্রয়াস মেনে নেয়া যায় না, তা অত্যন্ত আপত্তিকর
ও নিন্দনীয়।
সবচে’ বেদনাদায়ক ও আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশ
আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের বীর নায়কদের অশালীন অশোভনভাবে গালাগাল দেয়া। এ দুষ্কর্মের
শিরোমণি (‘অজা বান্দর’) হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত আমলা শরদিন্দু শেখর চাকমা। সরকারের নিয়োজিত
ভাড়াটে লেখক, গবেষক ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী প্রচার-প্রচারণায় নানাভাবে পাহাড়িদের
হেয় ও তাচ্ছিল্য করলেও কেউই শরদিন্দু শেখর চাকমার মতো এত কদর্যভাবে ব্রিটিশ আগ্রাসন
প্রতিরোধ যুদ্ধের জাতীয় বীরদের গালমন্দ করার স্পর্ধা দেখায়নি।
ঢাকায় জুম্মোদের দেয়া এক সম্মাননা সভায় (৯
ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ডব্লিউওয়াইসিএ, মোহাম্মদপুর) দেয়া বক্তৃতায় শরদিন্দু বাবু ব্রিটিশ
আগ্রাসন প্রতিরোধের বীর নায়কদের “বেকুব” বলে গালাগাল করেছেন, এমন কথাবার্তায় পাহাড়ি
বিদ্বেষী শত্রুপক্ষ উল্লিসিত হবে তাতে সন্দেহ নেই। এ বক্তব্যকে যারপরনাই অজ্ঞতাপ্রসূত
কাণ্ডজ্ঞানহীন মতিভ্রমগ্রস্ত ব্যক্তির প্রলাপ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। সরকার অর্থাৎ
ক্ষমতাধর শক্তিশালী শক্তির বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়ায় শরদিন্দু বাবুর চোখে তারা “বেকুব”
আর “অপরিণামদর্শী”। যতদূর জানা যায়, কেবল ব্রিটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই
নয় পার্বত্যবাসীর কোন আন্দোলন সংগ্রাম তিনি কখনই মানতে পারেননি, সমর্থন করেননি। পাকিস্তান
আমলে ছাত্ররা সংগঠন গড়ার প্রস্তুতিকালে নিরুৎসাহিত করতেন, ‘সরকারি চাকুরি পাওয়া যাবে
না’ বলে ভয় দেখাতেন। তার আপন শ্যালক ‘বাদিগ্রুপের’ শীর্ষনেতা প্রীতি কুমার চাকমা (অতীতের
কিছু স্মৃতি ও শান্তিবাহিনী, পৃষ্ঠা : ২৫) তা উল্লেখ করেছেন। নতুন প্রজন্মের জানা না
থাকলেও, শান্তিবাহিনী আমলে সশস্ত্র লড়াই নিয়ে তার নানা নেতিবাচক কথাবার্তা এখনকার মাঝবয়সী
ব্যক্তিরা ভুলে যায়নি। তাকে ঘিরে সে সময়ে নানা কথাবার্তা প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে হয়ত
কিছু অতিরঞ্জিতও হতে পারে। তবে সে সব কথাবার্তা শোভন বা সম্মানজনক বলা যায় না। পাহাড়ি
জনগণের বর্তমান সময়ের বাঁচা-মরার লড়াই ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ আন্দোলন নিয়েও শরদিন্দু
বাবুর বিরূপ কথাবার্তা অজানা নয়। তিনি মনপ্রাণ দিয়ে যে বস্তুটির ওপর আস্থা রেখেছেন
সেটি হচ্ছে বিতর্কিত ‘পার্বত্য চুক্তি’, বিগত ২৭ বছর ধরে সেটি অচল অবস্থায় রয়েছে। বিতর্কিত
চুক্তির মাধ্যমে জনগণের মৌলিক দাবি অর্জিত না হলেও তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এ থেকে
লাভবান হয়েছেন।
![]() |
ঢাকায় জুম্মোদের দেয়া এক সম্মাননা সভায় (৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ডব্লিউওয়াইসিএ, মোহাম্মদপুর) দেয়া বক্তৃতায় শরদিন্দু বাবু ব্রিটিশ আগ্রাসন প্রতিরোধের বীর নায়কদের “বেকুব” বলে গালাগাল করেন। |
আসলে শরদিন্দু বাবু হলেন একজন আপাদমস্তক আমলা,
সরকারের একান্ত অনুগত সেবাদাস। কীভাবে নিজের পাতে ঝোল টানতে হয়, সেটা তিনি ভাল করে
রপ্ত করেছেন। যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তার কাছ থেকে কীভাবে সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে
হয় সে ব্যাপারে তিনি সিদ্ধহস্ত, পাহাড়ি আমলাদের মধ্যে খুব কম জনই আছে যে তাকে সে ব্যাপারে
টেক্কা দিতে পারে। বাংলাদেশের আমলারা যে কলা-কৌশল অবলম্বন করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে
উপরে উঠেছেন, আমলা হিসেবে তিনিও তাই করবেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু দোষণীয়
ও আপত্তির জায়গাটা হচ্ছে এই, তিনি তার ‘অনুসৃত পন্থাকে’ পুরো জাতির সম্মুকে অনুকরণীয় ‘আদর্শ’ হিসেবে তুলে
ধরতে চান। তিনি এটা বুঝতে অক্ষম যে, আমলার বুদ্ধিতে ব্যক্তি বিশেষের লাভ, চাকুরিতে
প্রমোশন, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সহ দ্রুত উন্নতি করা যায়, সেটা তিনি ভালোই
করেছেন। কিন্তু তাতে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় না। দুনিয়ার কোথাও সরকারি আমলা
জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন, তার নজীর মেলে না। বৃহৎ কিছু অর্জন করতে হলে পার্বত্য
চট্টগ্রামের জনগণকে অবশ্যই লড়াই সংগ্রাম করতে হবে, তা যত কঠিন বা ঝুঁকিপূর্ণই হোক।
জনগণকে বিভ্রান্ত, আত্মবিশ্বাসহীন দুর্বলচিত্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত করে শাসন-শোষণ দমন-পীড়ন
নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লড়াই সংগ্রাম
সম্পর্কে বিদ্বেষ জাগিয়ে তরুণ-যুবসমাজের সবাইকে সরকারি চাকরিমুখী, ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রীক
ও আপন স্বার্থসিদ্ধিতে নিয়োজিত হতে প্ররোচনা দেয়া প্রকৃত প্রস্তাবে শাসকগোষ্ঠীর নীলনক্সা
বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখার সামিল।
শরদিন্দু বাবুর ব্যাপারে আপত্তির জায়গা আরও
এই যে, আপন পরিচিতি ও মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি অকারণে ও অপ্রয়োজনে অন্যদের খাটো
করে থাকেন। তার আত্মজীবনী (আমার জীবন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম) বইয়ে তার সমসাময়িক ও বয়ঃজ্যোষ্ঠ
অনেকের ব্যক্তিগত বিষয় (ডাক্তারি রিপোর্ট)-দুর্বলতা ফাঁস করে দিয়েছেন। নিজে কাকে, কখন,
কী.. উপকার করেছেন তার দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়েছেন। কিন্তু শরদিন্দু শেখর চাকমা শুরু থেকে
তো ‘অতিরিক্ত সচিব’ ছিলেন না। জীবনের প্রতি পদে পদে তার ভাষায় সেই ‘বোকা’ ও ‘অপরিণামদর্শী
উপজাতিদের’ যে সহায়তা পেয়েছেন, তা স্বীকার করলে তার সম্মান ক্ষুণ্ন হতো না। বুঝা যায়
বেশ সচেতনভাবে সে সব এড়িয়ে গেছেন।
নিজেকে একজন “সৎ”, “সাহসী”, “স্পষ্টবাদী”
ও “পরোপকারী” হিসেবে জাহির করতে গিয়ে কতক ক্ষেত্রে সচেতনভাবে অর্ধসত্য বয়ান দিয়েছেন,
যারা তার বর্ণিত ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট তারাই প্রকৃত ঘটনা ও আসল সত্য জানেন, যদিও কেউই
এখন পর্যন্ত সে বিষয়ে কিছু লেখেন নি। তার আত্মজীবনীতে দরকারি-প্রয়োজনীয় তথ্য বলতে তেমন
কিছু নেই। বইটি শেষ অবধি পড়াও কষ্টকর, অহেতুক আপন গুণকীর্তনে পাতা ভরিয়ে ফেলেছেন। তিনি
যেভাবে অন্যকে উপকার করার ফিরিস্তি দিয়েছেন, আমাদের সামাজিক মানদণ্ডে তা মোটেও শোভন
নয়। বই লিখে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জনসমক্ষে কাউকে হেয় করা ও সামাজিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায়
ফেলে দেয়ার নাম পরোপকার নয়। অথচ সরকারের দালাল ও জনগণের শত্রুদের বিরুদ্ধে সেভাবে তিনি
সোচ্চার হতে পারেন নি। অনেক জনকে টেনে এনে কটুকাটব্য ও একতরফাভাবে সমালোচনা ও গালাগাল
দিলেও এরশাদের আমলে উপদেষ্টা বিনয় দেওয়ানকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। বুঝতে কষ্ট হয় না, বিনয়
দেওয়ান এরশাদের আমলে একজন সাক্ষীগোপাল মার্কা উপদেষ্টা হিসেবে সমাজের জন্য কিছু করতে
না পারলেও ব্যক্তি শরদেন্দু বাবুকে বড় উপকার করেছেন। সত্যভাষী হয়ে থাকলে বিনয় দেওয়ানের
অকর্মা ভূমিকা নিয়েও শরদিন্দু বাবুর সমালোচনা করা উচিত ছিল, তাতে সরকারি দলে যোগদানের
ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যেত, তা তিনি করেননি।
তাসের আসর ও অন্যান্য আড্ডায় নানা কথা হলেও
আজ পর্যন্ত কেউ শরদিন্দু বাবুর আপত্তিকর কথাবার্তা ও অর্ধসত্যের ব্যাপারে লিখিতভাবে
জবাব দেন নি। হয়ত তার লেখাকে ততটা আমলে নেয় নি, অনেকে তার লেখা সেভাবে গুরুত্বও দেয়
না। কিন্তু লোকজনের এ নিষ্পৃহতা ও নিরবতাই শরদিন্দু বাবুকে বলতে গেলে লাগামহীন ও বেপরোয়া
করে তুলেছে। ধরাকে সরা জ্ঞান করে শেষ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্রিটিশ আগ্রাসন
প্রতিরোধের বীর নায়কদেরও ‘চামচিকার মত লাথি মারতে’ উদ্যত হয়েছেন, যা কিছুতেই বরদাস্ত
করা চলে না। সে কারণে শরদিন্দু শেখর বাবুকে নিয়ে দু’টি কথা বলতে হচ্ছে। এ যাবৎ তো তিনি
একপাক্ষিকভাবে গালমন্দ দিয়ে চলেছেন।
প্রথমে আইরিশদের কথা স্মরণ করা দরকার, তারা
এখনও উত্তর আয়ারল্যান্ডে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। ইংরেজদের ব্যাপারে আইরিশদের
কথা হচ্ছে ‘England yields nothing without bomb!’ অর্থাৎ ‘বোমা ছাড়া ইংরেজদের কাছ থেকে কোন কিছু আদায় করা যায় না’। সে যুগে
শের দৌলত খাঁ, রুণু খাঁদের তো বোমা থাকার প্রশ্ন উঠে না। তারা সবচে’ কার্যকর গেরিলা
পদ্ধতিতে ইংরেজদের ঘায়েল করেছেন। এজন্য দক্ষিণ এশিয়ার সমরবিজ্ঞানে তারা এখনও নমস্য
হয়ে রয়েছেন। ইতিহাস অনুসন্ধানী নতুন প্রজন্মের ইউটিউবার-ব্লগাররা এ প্রতিরোধ লড়াইয়ের
উচ্চ প্রশংসা করছেন, সরকারের অনুগ্রহভাজন আমলাদের সে সব জানার বা মানার কথা নয়।
শেষ কথা এই, শের দৌলত খাঁ, জান বক্স খাঁ,
রুণু খাঁসহ সে যুগের ব্রিটিশ আগ্রাসন প্রতিরোধের বীর নায়কগণ এ দেশের সংগ্রামী মানুষের
নিকট অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। যত অপপ্রচার ও তথ্য বিকৃতি ঘটানো হোক, এ অঞ্চলের
ইতিহাসে সম্মানের সাথে উল্লেখিত হবে তাদের কথা। ভবিষ্যতে এদেশে যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন
ঘটে, তাহলে তাদের সম্মানে স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হবে তা ধারণা করা যায়। এটা রূঢ় শোনালেও
সত্য যে, শরদিন্দু বাবুর মতো আমলারা চামচিকা হয়ে বৃহৎ হাতিকে লাথি মারতে চাইলে মুখ
থুবড়ে পড়ে পদতলে পিষ্ট হবে, তাদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। জীবনের ছায়াহ্নে
শরদিন্দু বাবু’র শুভবুদ্ধির উদয় হবে, ব্রিটিশ আগ্রাসন প্রতিরোধের নায়ক জাতীয় বীরদের
ব্যাপারে আপত্তিকর কথা প্রত্যাহার করবেন, বিতর্কিত বই প্রত্যাহার করে জনগণের কাছে ক্ষমা
চাইবেন তার কাছে এটাই বিনীত আহ্বান। #
লেখকগণ:
* সমর চাকমা, সহসভাপতি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ,
কেন্দ্রীয় কমিটি।
* সোহেল চাকমা, সহসাধারণ সম্পাদক, পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।
* রোনাল চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক, পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।
১ আগস্ট ২০২৫
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।