ভয়ংকর রূপে সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তা

Google Alert – সেনা

শেখ আবু মেহেদী ও সরদার আমান উল্লাহ। দুজনই সাবেক মেজর। শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৪ সালে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন তারা। জুলাই (২০২৪) গণ-অভ্যুত্থানের পর ভয়ংকর প্রতারণায় নেমেছেন এ দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। কখনো গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর পরিচালক আবার কখনো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কনসালট্যান্ট পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। খ্যাতিমান সৌরবিদ্যুৎ উদ্ভাবক প্রকৌশলী শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর একটি অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে এ দুইজনের বিরুদ্ধে প্রতারণার ভয়াবহ তথ্য পেয়েছে ডিবি পুলিশ। এ দুই সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে গিয়াস উদ্দিন নামে আরও একজনকে শনাক্ত করেছে ডিবি। তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক।

জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর যৌথ বাহিনী দিয়ে প্রকৌশলী শাহরিয়ারকে গ্রেফতারের ভয় দেখান সাবেক মেজর শেখ আবু মেহেদী, সরদার আমান উল্লাহ ও কথিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন। গত বছরের ১৪ আগস্ট আসামি আমান উল্লাহ বাদী প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরীর মোবাইল নম্বরে কল করে নিজেকে এনএসআই-এর কর্মকর্তা পরিচয় দেন। তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক উন্নয়নমূলক অনেক প্রকল্পের তথ্য চান। এরপর যৌথ বাহিনী দিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে প্রথমে তিনজনে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেন। পরে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক নিয়ে যান। আদালতে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরী। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক অভিযোগটি আমলে নিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এ অভিযোগ তদন্ত করতে নেমে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে চক্রের প্রতারণার ভয়াবহ প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এমনকি হুমকি দেওয়ার অডিও ছাড়াও চেক নেওয়ার তথ্যপ্রমাণসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধার করেছে পুলিশ।

জানতে চাইলে ডিবির তেজগাঁও জোনের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) রাকিব খান বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সাবেক মেজর শেখ আবু মেহেদী, সরদার আমান উল্লাহ ও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক পরিচয়ধারী গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার স্বার্থে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত অভিযোগের নথিপত্র যুগান্তরের কাছে এসেছে। এতে দেখা গেছে, সরকারি কর্মকর্তার (এনএসআই) ছদ্মবেশ ধারণের মাধ্যমে ভীতিপ্রদর্শন ও প্রতারণা করা শেখ আবু মেহেদী, সরদার আমান উল্লাহ ও গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১০৯, ১৭০, ৩৮৭, ৪২০ ও ৫০৬ ধারার অভিযোগ আনা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্ট ধারার অপরাধ আমলে নিয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে প্রতিবেদনটি দাখিল করেন ডিবির তেজগাঁও জোনের সংঘবদ্ধ অপরাধ, গাড়ি চুরি-উদ্ধার ও প্রতিরোধ টিমের ইনস্পেকটর মাজহারুল ইসলাম। গত ২৯ জুলাই ১৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি সিএমএম কোর্টের ডিসি প্রসিকিউশনের দপ্তরে দাখিল করা হয়।

নথিপত্রে দেখা যায়, আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে পৃথক মোট সাতজনের ১৬১ ধারায় সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে শাওন সাহা নামে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা শেখ আবু মেহেদীর পক্ষে প্রকৌশলী শাহরিয়ারের কাছ থেকে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন। ডিবি পুলিশের কাছে লিখিত জবাবনবন্দিতে শাওন সাহা বলেন, অভিযুক্ত সাবেক সেনা কর্মকর্তা শেখ আবু মেহেদীর ট্যাক্স ফাইল নিয়ে তিনি কাজ করেন।

পাশাপাশি মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় অবস্থিত সাইকা শান্তা অ্যাসোসিয়েশনে হিসাবরক্ষক পদে কর্মরত তিনি। গত বছরের ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় শেখ আবু মেহেদী তাকে গিয়াস উদ্দিনের (কথিত সাপ্তাহিকের সম্পাদক) সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এর আগে তিনি গিয়াস উদ্দিনকে চিনতেন না। ওইদিন গিয়াস উদ্দিনকে ফোনে কল দিলে তাকে ধানমন্ডি ২৭ এলাকায় কফি ওয়ার্ল্ডে যেতে বলেন। সেখানে গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওই সময় গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে একজন ভদ্রলোক (প্রকৌশলী শাহরিয়ার) বসে ছিলেন। গিয়াস উদ্দিন তাকে প্রকৌশলী শাহরিয়ারের সঙ্গে কফি ওয়ার্ল্ডের আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বলেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে রাখা গাড়িতে প্রকৌশলী শাহরিয়ার উঠতে বলেন। তখন একটি খাকি খাম তার হাতে দেওয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে আসার সময় খাম থেকে টাকাগুলো নিচে পড়ে যায়। পরে প্রকৌশলী শাহরিয়ারসহ তিনি নিজে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা আবার খামে ভরে কালো রঙের একটি স্কুল ব্যাগে ভরে নেন। শাওন সাহা এভাবেই টাকাসহ আবু মেহেদীর অফিসে চলে যান উল্লেখ করে জবানবন্দি দেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মিন্টু রোডে ডিএমপি ডিবি গেটের সামনে গিয়ে অভিযোগটির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই মাজেদ আলীকে হুমকি দিয়ে ভয় দেখান শেখ আবু মেহেদী। এ বিষয়ে ডিবির অভ্যন্তরীণ নোটে বিষয়টি লিপিবদ্ধ করে রাখেন মাজেদ আলী। পরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করে ইনস্পেকটর মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের ওপর ন্যস্ত করা হয়।

ডিবি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরী সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন, এর সত্যতা পাওয়া গেছে। শেখ আবু মেহেদী ও সরদার আমান উল্লাহ নিজেদের এনএসআই-এর কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রকৌশলী শাহরিয়ারকে যৌথ বাহিনী দিয়ে তুলে নেওয়ার ভয় দেখান। এরপর ‘শাওন সাহা’ নামে তাদের এক সহযোগীকে তার (শাহরিয়ার) কাছে পাঠিয়ে ৪টি চেক এবং নগদ সাড়ে ১৮ লাখ টাকা নেন। ৪টি চেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লিখে ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টাও করেন সাবেক এ দুই সেনা কর্মকর্তা। প্রকৌশলী শাহরিয়ার চেক প্রতারণার বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়ে রাখায় তারা টাকা তুলে নিতে পারেননি। তবে নগদ টাকা নিয়ে গেছে চক্রটি।

জানা যায়, মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই মাজেদ আলী তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে শাওন সাহাকে শনাক্ত করে আটক করেন। এ সময় ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শাওন সাহা প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। পুলিশ হেফাজতে অপরাধ স্বীকার করার পরও ডিবির যুগ্মকমিশনার রবিউল ইসলাম শাওন সাহাকে ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে তার (রবিউল) নির্দেশে শাওন সাহাকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওই কর্মকর্তা বলেন, সেনা কর্মকর্তারা শাওন সাহাকে ছেড়ে দিতে বলেছেন-এমন তথ্য সঠিক ছিল না। মূলত ভুয়া গোয়েন্দা কর্মকর্তার পরিচয়ধারী সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে রক্ষা করতেই শাওন সাহাকে কৌশলে ছেড়ে দেন ডিবির যুগ্মকমিশনার রবিউল ইসলাম। তিনি মামলাটি ফাইনাল রিপোর্ট দিতে প্রভাব বিস্তার করছিলেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির যুগ্মকমিশনার (ডিএমপি নর্থ) অতিরিক্ত ডিআইজি রবিউল ইসলাম বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিবাদী আবু মেহেদী অভিযোগ করেছিলেন তার কোনো বক্তব্য তিনি (তদন্তকারী কর্মকর্তা) নিচ্ছেন না। তখন আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছিলাম তিনি যেন বিবাদীদের সঙ্গে কথা বলেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার নির্দেশে শাওন সাহাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, অভিযোগটি সঠিক নয়। আমি কাউকে ছেড়ে দিতে বলিনি। তবে ডিবির তদন্তকারী দল ঘটনাস্থল থেকে ফুটেজসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করেছে। শাওন সাহাকে আসামি না করে কেন সাক্ষী করা হয়েছে, তা আমার জানা নেই।

দুদকের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তা দুদকের কনসালট্যান্ট পরিচয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন-এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় দুদক কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে প্রেস নোট প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘কিছু ব্যক্তিবিশেষ বিভিন্ন স্থানে দুদকের কনসালট্যান্ট, উপদেষ্টা বা সহযোগী পরিচয় দিচ্ছেন। এসব পদে দুদক কাউকে নিয়োগ করেনি। ২৪ জুন প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ বিষয়ে জনসাধারণকে সতর্ক করে। ডিবি পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে এই অভিযোগেরও সত্যতা পাওয়া গেছে।

জানা যায়, প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরী গত বছরের ২৮ আগস্ট সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তার বিষয়ে ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করতে যান। ওই সময় গণ-অভ্যুত্থানে থানা ভাঙচুর হওয়ায় মামলা নেওয়ার মতো অবস্থা নেই বলে তার অভিযোগটি জিডি করে রাখা হয়। জিডি নং ১৪৪৭। এরপর পুলিশের পরামর্শে ৩ সেপ্টেম্বর সরকারি কর্মকর্তার ছদ্মবেশ ধারণ করে ভয়ভীতি, প্রতারণা, মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি এবং অপরাধে সহায়তা করার অভিযোগ এনে আদালতে সিআর মামলা করেন তিনি। সিআর মামলা নং-৫৭৯/২০২৪ (মোহাম্মদপুর)। মামলায় গোয়েন্দা কর্মকর্তা পরিচয়ধারী শেখ আবু মেহেদী ও সরদার আমান উল্লাহ ছাড়াও গিয়াস উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে শেখ আবু মেহেদী যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক। প্রকৌশলী শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে বিগত সরকারে সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সেগুলো আমি ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করছিলাম। এমন সময় এই মামলা করা হয়েছে।

প্রকৌশলী শাহরিয়ারকে অপরহণের ভয় দেখিয়ে ২০ লাখ টাকা ও চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জবাব না দিয়ে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। তবে মামলায় অপর দুই অভিযুক্ত সরদার আমান উল্লাহ ও গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *