ভরসার ভিত্তি কোথায়? 

দেশ রূপান্তর

তাহলে কার ওপর ভরসা করব? প্রতিদিনের ঘটনা দেখে ও শুনে এটি, ভরসা হারানো মানুষের খেদোক্তি। সাধারণ মানুষ কী করে সারাজীবন? আশায় বুক বাঁধে, ভরসায় অপেক্ষা করে আর আশা-ভরসা পূরণ না হলে, ক্ষোভ ঝাড়ে। ব্যর্থ হলে নিজেকে দায়ী করে, কপালকে দোষারোপ করে, দোষ চাপানোর জন্য কাউকে খোঁজে আর শেষে হতাশ হয়ে বসে থাকে। কিন্তু জীবন বড় গতিময়। নিত্যনতুন প্রয়োজন এসে হাজির হয়, হতাশ হয়ে বসে থাকার উপায় নেই। ফলে আবার নেমে পড়তে হয়, জীবনের ঘানি টানার কাজে। আর তাদের রাগ, ক্ষোভ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সব যেন সরকারের বিপক্ষে উগরে দেয়। সরকারের চার পাশে যারা থাকে, আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো তাদের আকস্মিক সম্পদ বৃদ্ধির ঘটনায় অবাক হয়। মানতে পারে না এই বিপুল পরিবর্তন। তাদের বিত্তবৈভব দেখে, ক্ষমতা দেখে তুলনা করে কিছুদিন আগে কী ছিল তাদের অবস্থা আর এখন কী হয়েছে? এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো, হচ্ছে কী এসব? অভ্যুত্থান শুধু প্রতিবাদ প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত তৈরি করেনি একটা আশাবাদ তৈরি করেছিল। দেশটা এবার আমাদের হবে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকবে, মানুষ থাকবে স্বস্তিতে এবং বাঁচবে মর্যাদা নিয়ে। এমন চাওয়া আন্দোলিত করেছিল দেশের মানুষকে। কিন্তু মানুষের আশা যেন ধাক্কা খেয়েছে, বাস্তবতার কাছে। মব সন্ত্রাস মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দখল করা প্রায় শেষ এবং সামনে নির্বাচন এই কারণে বড় আকারের ঘটনা ঘটছে না, কিন্তু বন্ধ হয়নি। সুযোগ সন্ধানীরা অপেক্ষায় আছে, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সরকারি ভূমিকা ভরসা দিতে পারছে না বলে আতঙ্ক আছেই। মাজার ভাঙা, বাউলদের চুল কেটে দেওয়া, অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে বাড়িঘর ভাঙা যেমন চলছে তেমনি গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও বন্ধ হয়নি। ফলে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার হাত থেকে মানুষের মুক্তি মেলেনি। 

একটা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পরিচালিত জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে  সমাজের নানা আর্থিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক উদ্বেগের কারণে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারিয়েছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত আলোচনা হচ্ছে, ঘুষ নেওয়া নাকি আগের থেকে কমেছে, কিন্তু কাজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার মানুষরা বলছেন, ৭৪ শতাংশ ক্ষেত্রে টাকা ছাড়া কিছু হয় না। এক সময় এটাকে ঘুষ না বলে, ‘স্পিড মানি’ বলা হয়েছিল। এই মানির স্পিড এত বেশি ছিল যে, টাকাগুলো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করতে গিয়েছিল। বিদেশের ব্যাংকে আমানত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর কি পরিবর্তন হচ্ছে? বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ‘পরিবার পর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান’ শীর্ষক এক আলোচনায় সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। জরিপের পারিবারিক মনস্তত্ত্ব অংশের ফলাফল তুলে ধরে তারা বলেছেন, ‘প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংকটের মধ্যে আছে। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় এবং ২৭ শতাংশ ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকটে আছেন।’ ঘুষের বিষয়ে বলা হয়, সরকারি কার্যালয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে। কিন্তু তারা বলেছেন ‘হয়রানি চলছে’। হয়রানির শিকার ৭৪ শতাংশ মানুষ বলছেন, টাকা না দিলে কিছুই হয় না। সরকারি সেবা নিতে হয়রানির শিকার হন ২১ শতাংশ মানুষ। স্বাস্থ্যসেবা নিতে হয়রানির হার প্রায় ৪৯ শতাংশ। মানুষ কেন উদ্বিগ্ন? মানুষ কি শুধু রাজনৈতিক ঘটনায় উদ্বিগ্ন? মানুষের উদ্বেগের আরও কারণ তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। সন্তানের শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ৬৫ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া কিশোর অপরাধ এবং মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন ৫৫ এবং ৫৬ শতাংশ মানুষ। মানুষ কেমন জীবন চান? ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষার বিষয়ে মানুষ ৫৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক সম্মান নিয়ে বাঁচার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি চান তারা। রাজনৈতিক  বিষয়ে ৫৬ শতাংশ মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধ করা উচিত বলেছেন। দুর্নীতি শুধু অর্থনীতিকে ধ্বংস করে, তাই নয় ধ্বংস করে মানুষের সাধারণ নৈতিকতার ভিত্তিও।

জরিপ বলছে, সার্বিকভাবে নানা সংকট ও উদ্বেগের কারণে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন। কী হবে দেশটার, এই হাহাকার শুনতে পাওয়া যায় চারপাশে। জরিপের ফল দেখে এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, এত রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পরও ৪৬ শতাংশ মানুষ কেন সরকার ও সমাজের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। প্রতিদিন পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয় তাতে এটা স্পষ্ট যে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের মধ্যে ভয় বাড়ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সমাজে প্রতিনিয়ত সংঘাতমূলক মনোভাব ছড়াচ্ছে। একদিকে দেশে কর্মসংস্থান নেই, অন্যদিকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগও কমছে, ফলে আতঙ্ক কর্মপ্রত্যাশীদের মধ্যে।  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি বলে যে প্রবণতা বিশ্বব্যাপী, বাংলাদেশ তার উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তি এবং সহনশীলতার জায়গা দখল করেছে উগ্রতা। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা বাড়লে তার প্রভাব কী হতে পারে, দেশে এবং বিদেশে এ নিয়ে ভাবনা কি আছে? আমাদের দেশের দেড় কোটি মানুষ দেশের বাইরে থাকেন, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি, তারা যেসব দেশে কাজ করেন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সেসব দেশেও প্রভাব ফেলে কিনা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি করে কিনা, উগ্রতার সময় এই ভাবনা কাজ করে না। কিন্তু ফল ভোগ করতে হয় দেশের সব মানুষকে। একটা দেশের মানুষের বড় অংশ আশাবাদী নয়, এটা উদ্বেগজনক। কেন এত দ্রুত মানুষের একটি বড় অংশ আশা হারিয়ে ফেললেন, সেটা গভীরভাবে চিন্তা করে ভূমিকা পালন না করলে, সমাজে অস্থিরতা বাড়বে। 

এর মধ্যে বিতর্কের বিষয় হিসেবে যুক্ত হয়েছে সরকারপ্রধানের জাতিসংঘ সফর। জাতিসংঘে বাংলাদেশের ভূমিকা এবং অবস্থান আর অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা নিয়ে প্রতিবার প্রশ্ন ওঠে, তুলনামূলক আলোচনা হয়। বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষে এত বড় অংশগ্রহণকারী দলের ব্যয়ভার বহন করা উচিত কিনা, এই প্রশ্ন সবার। এবারও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে গিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, বিমানবন্দরে প্রতিবাদ করবে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা। নানা ঘটনা, উত্তেজনা আর লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে বিমানবন্দরে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা দেশ নিয়ে ভাবেন, দেশে টাকা পাঠান, বিদেশে থাকলেও তাদের মন পড়ে থাকে দেশে, তারা দেশের মতো করেই রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেন এটা সবাই জানেন। ফলে তাদের মনোভাব, ক্ষোভ প্রকাশের ধরন তো জানা আছে। তাহলে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেওয়া হয়নি কেন, এই প্রশ্ন উঠেছে? এর পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী আসলে কতজন? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি পুস্তিকা অনুযায়ী ইউনূসের সফরসঙ্গী ৬২ জন। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, এই সংখ্যা ১০৪। সংখ্যার এত পার্থক্য কেন?  তালিকায় চার উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বিশেষ দূত, প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ছাড়াও নিরাপত্তা কর্মকর্তা ১৯ জন ও সরকারি কর্মকর্তা ৪৭ জন আছেন। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এত বড় প্রতিনিধি বহর কি আসলে প্রয়োজন? এক্ষেত্রে অতীতের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। জাতিসংঘে  কারা গিয়েছেন, কেন গিয়েছেন, কতজন গিয়েছেন, এতজন যাওয়ার দরকার কী ছিল এসব প্রশ্ন অতীতেও ছিল, এখানও যদি উঠে তাহলে পার্থক্য কোথায়?

মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।  আয় বাড়ানোর পথ তৈরি হচ্ছে না। ঘুষ বা অনৈতিক পথে আয় করতে পারে দেশের কত শতাংশ মানুষ? আর তাদের আয় বাড়ানোর বোঝা বহন করতে হয় কত মানুষকে? দুর্নীতি করতে পারে না সবাই। কিন্তু দুর্নীতির সংস্কৃতি আচ্ছন্ন করে প্রায় সব মানুষকে। সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এই যুক্তি, সবাই দুর্নীতিবাজ। কেউ পঞ্চাশ টাকার দুর্নীতি করে কেউ করে ৫০ কোটি টাকার। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দুর্নীতি করে না, দুর্নীতির শিকার হয়। কিন্তু তারাই আবার দুর্নীতিকে স্বীকৃতি দেয়, সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। দুর্নীতি করাকে যোগ্যতা বলে তারিফ করে আবার বলতে থাকে, কাকে বিশ্বাস করব ভাই? দুর্নীতির যে রাজনীতি আছে, তা অনেকে মনে করেন না। কিন্তু ভাবতে না চাইলেও, এর হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। যাদের ওপর দেশের ভার, তারা কি শুধু নিজেদেরটাই দেখবেন? নিজের আত্মীয়, নিজের অঞ্চল, নিজের দলের স্বার্থে দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা বরাদ্দ করবে? সৎ মানুষও যদি স্বজনপ্রীতি করে, তাহলে তা কি দুর্নীতি নয়? দুর্নীতিবাজ হলেও তিনি আমার এলাকার লোক, পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে আমাদের এলাকায় বরাদ্দ বেশি করেছেন অতএব তিনি আমাদের প্রিয়। এই মানসিকতা সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করবে না। ভোটের সময় নগদ টাকা, শাড়ি, লুঙ্গি দিয়ে দরিদ্র মানুষের ভোট নেওয়া সবাই দেখে কিন্তু এতে মানুষের নৈতিক অধঃপতন কতটা ঘটে তা বিচার করতে চান না অনেকেই। কে কত বেশি দুর্নীতি করতে পারে তা দিয়ে সক্ষমতার বিচার আর কে কম দুর্নীতি করে, তা দিয়ে সততার বিচার করলে মানুষ ভরসা পাবে কীভাবে? ভরসার ভিত্তি ব্যক্তিতে নয়, ব্যবস্থায়। শোষণ লুণ্ঠন চলবে, ক্ষমতা থাকলে কোনো জবাবদিহিতা নেই, কেউ কিছু বলবে না, এটাই অব্যাহত থাকবে? আসলে এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছে মানুষ, যেখানে কেউ চাইলেও যেন দুর্নীতি করতে না পারে। সম্পদের সুসম বণ্টন ও সম্পদের জবাবদিহিতা সেক্ষেত্রে প্রথম ধাপ। এটা বাদ দিয়ে, পরের ধাপে যাওয়া যাবে না।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

[email protected]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *