BD-JOURNAL
এক বছর নয়, দুই বছর নয়, প্রায় ১৭ বছর পর মানসিক ভারসাম্যহীন সাদিকুল ইসলাম সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
২০০১ সালে ঢাকায় একটি লোহার রড তৈরি কারখানায় চাকরি করতেন। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে তিনি ঢাকায় বসবাস করতেন। সেখান থেকেই হঠাৎ তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ঢাকা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর মাঝে মধ্যেই বাড়ি থেকে এদিক সেদিক চলে যায়। কারো ফসলের ক্ষেত বা কারো আসবাবপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীদের অভিযোগ আর অভিযোগ। অভিযোগ পেয়ে পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় পায়ে শিকল বেঁধে রাখতে। কয়েক বছর পায়ে শিকল পড়া অবস্থায় ছিল সাদিকুলের।
পায়ের শিকল খোলা পেয়ে। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ২৮ বছর বয়সে সাদিকুল ইসলাম ২০০৭ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এবার সুস্থ হয়েই দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সাতোর ইউনিয়নের দক্ষিণ দলুয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরলেন সাদিকুল ইসলাম (৪৫)।
পরিবার ধরেই নিয়েছিল হয়তো বা সাদিকুল মারা গিয়েছে। হঠাৎ ১৭ বছর পর নিজ বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেন দক্ষিণ দলুয়া গ্রামের আকবর আলীর বড় ছেলে সাদিকুল ইসলাম। তার ফিরে আসাটা যেন অনেকটাই স্বপ্নের মতই মনে করছেন নিকট আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব।
এদিক সেদিক সাদিকুল চলে গেলেও দুই তিন দিন পর আবার বাড়িতে ফিরে আসতো। কিন্তু এবার পালিয়ে গেল আর ফিরে আসলো না সাদিকুল। পরিবারের সদস্যরা নিকট আত্মীয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় সাদিকুলকে খুঁজেছে কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। যে যখনি খবর দিয়েছে এক পাগলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সেখানেই পরিবারের লোকেরা খুঁজেছেন। সাদিকুলকে কোথাও না পেয়ে একসময় পরিবারের লোকেরা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। সাদিকুল হয়তোবা আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই কিন্তু সাদিকুলের মা সিদ্দিকা বেগম আশা ছেলে হয়তোবা একদিন ফিরে আসবে। মায়ের আকুতি বিভিন্ন সময়ে রোজা ও নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা। যেন কবুল হয়েছে হঠাৎ একদিন পুলিশ বাড়িতে এসে জানিয়ে গেল সাদিকুল বেঁচে আছে। সুস্থ আছে তবে দেশে নেই ভারতের কলকাতা শহরের একটি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করার পর সে এখন অনেকটাই সুস্থ রয়েছে। পুলিশের কথামতো একদিন ভিডিও ফোনে সাদিকুল এর সাথে প্রথম পরিবারের বাবা মা ভাইদের সাথে কথা হয়। ১৭ বছর পর পরিবারের অনেকেই শারীরিক চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে তবে ছেলে ভিডিও ফোনেই মা সিদ্দিকা বেগমকে চিনতে পারে। ছেলে সাদিকুলের মা……মা বলে ডেকে ওঠার পর মা সিদ্দিকাও দূর থেকে ছেলের কন্ঠে মা…. মা ডাক শোনার পর আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। দুই দেশের কাগজপত্র যোগাড় করা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর গত ২৪ ডিসেম্বর ২৪ আনুষ্ঠানিকভাবে সাদিকুল সহ সাদিকুলের মতো আরও ২৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
সাদিকুল এখন নিজের গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ দলুয়া গ্রামে অবস্থান করছেন। সাদিকুলের বাড়ির পাশের বাবলুর ফার্ম বাজারে বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন গল্পে মশগুল। কথা হয় সেখানেই আমাদের এই প্রতিবেদকের সাথে।
সাদিকুলেরা চার ভাই। সাদিকুল সবার বড় এরপর তাদের বোন একমাত্র বোন মিনিয়ারা বেগম লাইলি। এরপর ভাই শফিউল ইসলাম, আজিজুল ইসলাম ও শাহাবুদ্দিন। তাদের বাবা আকবর আলী ও মা সিদ্দিকা বেগমের সাথে নিজ বাড়িতে অবস্থানকালে অনেকেই দেখতে আসছেন। এখন সাদিকুলকে তার বন্ধু-বান্ধব ভাই-বোন পাড়ার প্রতিবেশী সকলকেই চিনতে পারছেন। বন্ধুদেরকে কাছে পেয়ে মুচকি হাসি দিলেও কি যেন নেই তার মধ্যে এমন কথা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যেই মিষ্টি হাসি দিলেও পরক্ষণেই আনমনা হয়ে পড়েন সাদিকুল ইসলাম। সাদিকুল এখন চোখে চশমা পড়েন এখন মাথার চুল বেশিরভাগই সাদা হয়েছে। মুখে খোসা খোসা দাড়ি আর সেই দিনের কথাগুলো বারবার মনে করার চেষ্টা করছে। সাদিকুল।
সাদিকুল ইসলাম এক সময়ের সংসার ছিল। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে। তার সেই সন্তানের নাম সাব্বির হোসেন। ছেলে সাব্বির এখন ২৩ বছরের যুবক। ১৭ বছর পর দাদার বাড়িতে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরার পর অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিল সাব্বির। বাবা সাদিকুল ইসলাম ও ছেলে সাব্বির হোসেন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কেঁদেছেন। এরপর বাবাকে রেখেই একমাত্র ছেলে সাব্বির হোসেন নানার বাড়িতে চলে যায়।
সাদিকুল ইসলামের ২০০১ সালে মানসিক সমস্যা দেখা দিলে ২০০২ সালে সেই সময়ে এক বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে সাদিকুলের স্ত্রী লিপিয়ারা বেগম বাবার বাড়িতে চলে যায়। সাদিকুল মানসিক সমস্যা বেশি হলে তার স্ত্রী লিপিয়ারা বেগম আর স্বামীর সংসারে ফিরে আসেনি। সাদিকুল ইসলামের মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার এক পর্যায়ে তাকে ডিভোর্স দেয় স্ত্রী লিপিয়ারা বেগম। স্ত্রী সন্তানকে না পাওয়া এবং পারিবারিক অসহ্য যন্ত্রণা মানসিক ভারসাম্য আরও যেন বেশি করে তাড়িয়ে বেড়ায় সাদিকুলকে। সবকিছুর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে। দিন দিন মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পায়। একসময় কোন এক অজানা উদ্দেশ্যেই মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে কিভাবে যেন ভারতে প্রবেশ করে। এরপর শুরু হয় সাদিকুলের অন্য জীবন।
সাদিকুলের সেই দিনের কথা কিছুই মনে নেই। তবে দীর্ঘদিন কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অঞ্জলি তাকে উদ্ধার করে ভারতের গুয়াহাটা একটি মানসিক হাসপাতালে দীর্ঘ ৬ বছর চিকিৎসার পর একটু সুস্থ হয়ে উঠে সাদিকুল। একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পর সেই অঞ্জলি হাসপাতালেই রোগীদের বেড বিছানা পত্র ওয়াশিং মেশিন দিয়ে পরিষ্কার করার কাজ করে সাদিকুল ইসলাম। এরপরও কেটে যায় আরো নয় বছর। যখন সাদিকুল ইসলাম তার নিজের নাম দেশের নাম জেলা এবং উপজেলা তার পরিবারের সদস্যদের কথা বলতে পারার পর সেই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে তার ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করেন। এক সময়ে তার ঠিকানা পাওয়ার পর তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চলতি বছরের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ফিরে আসেন সাদিকুল।
সাদিকুল ইসলাম বলেন, ভারতের কলকাতা শহরের গুয়াহাটা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করিয়েছিলেন সেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক দিদি। তার পরম যত্নে আমি আস্তে আস্তে সুস্থ হওয়ার পর তারাই আমাকে বলে এটি কলকাতা শহর। তাদের প্রচেষ্টায় আমি হাসপাতালের বিছানা পত্র ওয়াশিং মেশিনে ধোয়ার চাকুরী করি। কিছু পয়সাও আয় রোজগার করি। আমাকে তারাই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে আসার পর এখন আমি আমার বাবা-মা ভাই-বোনদেরকে পেয়েছি। অনেক বন্ধুবান্ধবকে চিনতে পারছি ভালো লাগছে। বন্ধু বান্ধবরা অনেকেই আমাকে দেখার জন্য আসছে। দীর্ঘদিন পর বন্ধুবান্ধবদেরকে দেখতে পেয়ে খুশি লাগছে। আমার ছেলে এসেছিল তাকে দুচোখ ভরে দেখেছি। ছেলে আমাকে বাবা বলে ডেকেছে আমি অনেক তৃপ্তি পেয়েছি।
সাদিকুলের মা সিদ্দিকা বেগম বলেন, অনেকেই অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু আমার মন বলেছিল আমার ছেলে বেঁচে আছে। আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছি। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে। আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। যারা আমার ছেলেকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছেন আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য দোয়া করছি তারাও যেন ভাল থাকেন।
বাবা আকবর আলী বলেন, আমার ছেলে যখন মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল ।তখন থেকেই আমরা তাকে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। মাঝেমধ্যে একটু সুস্থ হলেও আবার সে আগের মতো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ত। তাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে পারিবারিকভাবে আর্থিক সংকট দেখা দিলেও আমরা চিকিৎসার হাল ছাড়িনি। হঠাৎ করেই ছেলে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি যখন দেখলাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছেলেকে কাছে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে।
ভাই আজিজুর ইসলাম বলেন,বড় ভাইকে যখন বেনাপোলের সীমান্ত দিয়ে যখন আমাদের কাছে পৌঁছে দিল। তখন যেন আমরা আকাশের একটা চাঁদ পেয়ে গেলাম। আমার ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। বাবা-মাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। সেই দৃশ্য এখন মনে পড়ে। ভাইকে এখন কাছে পেয়েছি অনেক ভালো লাগছে। তবে দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা ভাইকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেছি গল্প করছি অনেক ভালো লাগছে।
বোন মিনিয়ারা বেগম লাইলী বলেন, সাদিকুল ভাই আমাকে অনেক আদর করত। ভাই যখন পাগল হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ছে। ভাইকে কত খুজেছি। কত কথা মনে পড়তো ভাই আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন মেলায় ঘুরতে নিয়ে যেতেন। ভাই যখন ছিল না তখন সেই দিনগুলির কথা বারবার মনে পড়তো। ভাই এখন ফিরে এসেছে অনেক ভালো লাগছে।
কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অঞ্জলি এর সিনিয়র প্রজেক্টর ম্যানেজার শুল্কা বড়ুয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় আমাদের এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, সাদিকুল কে আমরা প্রায় ছয় বছর চিকিৎসা করিয়েছি সুস্থ করতে পেরেছি। তবে তার এখনো ওষুধ চলছে। তাকে তার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিতে পেরেছি নিজের কাছে প্রশান্তি লাগছে। সাদিকুল এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। তার এখনো ওষুধ নিয়মিত সেবন করতে হয়। সে যদি চায় তাহলে আবার আমাদের এই প্রতিষ্ঠানে যে কাজ করেছে সেই কাজ করতে পারবে। এবং তার পরিবারের সাথে সবসময় যোগাযোগ করতে পারবে। কারো প্রতি আমাদের একটি মমতা রয়ে গিয়েছে। সে অত্যন্ত বিনয়ী একটি ছেলে। তার জন্য সব সময় শুভ কামনা করি আমরা।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি