ময়নামতী যুদ্ধসমাধিতে শায়িত ৭১৫ সৈনিক

Google Alert – সেনা

ময়নামতী ওয়ার সিমেট্রি একটি যুদ্ধসমাধিস্থল। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বুড়িচং উপজেলায় ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত এটি। সমাধিস্থলজুড়ে ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ নৈসর্গিক পরিবেশ। যেন পাহাড়ের কোলে সাজানো সবুজ গালিচা। প্রায় ৬ একর ভূমির এ ওয়ার সিমেট্রিতে (যুদ্ধসমাধি) এমন স্নিগ্ধ পরিবেশে ঘুমিয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো বিশ্বের ১২টি দেশের ৭১৩ জন সৈনিক।

কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার এ যুদ্ধসমাধি এখন কুমিল্লার ঐতিহাসিক স্থান। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন এখানে। পরিবার-পরিজন ছাড়াও বন্ধুবান্ধবসহ নানান বয়সি মানুষ ঘুরতে আসেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোয় দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে সমাধিস্থল। এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ স্মারক দেখতে অনেক বিদেশিরও আগমন ঘটে। কুমিল্লায় যুদ্ধ না হলেও কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধিস্থল নির্মিত হয়েছিল-এমন প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খায়।

ইতিহাসবেত্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪১ সালের ১১ ডিসেম্বর জাপানের ১৫ ডিভিশন সেনাবাহিনী বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে জাপানিজ বাহিনীর প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সূচনা হয়। জাপানিজ সেনাবাহিনীর হাত থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে রক্ষা এবং হারানো রাজ্য বার্মা পুনরুদ্ধারের মিশনে জেনারেল উইলিয়াম স্লিমের নেতৃত্বে মাঠে নামে ব্রিটিশ বাহিনী।

১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানিজ বাহিনীর সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর বেশকিছু রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়, যার মধ্যে অন্যতম কোহিমার যুদ্ধ ও আরাকানের যুদ্ধ।

১৯৪৫ সালের ৬ মে জেনারেল ফ্রাঙ্ক মেসারভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) দখলের মধ্য দিয়ে এই ফ্রন্টে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এর আগে বিভিন্ন ফ্রন্টে নিহত ব্রিটিশ সেনাদের উপযুক্ত মর্যাদায় সমাহিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় বেশকিছু ওয়ার সিমেট্রি।

এগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে ময়নামতী ওয়ার সিমেট্রি। যেখানে উঁচু-নিচু পাহাড়ের নৈসর্গিক পরিবেশে ঘুমিয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী ৭৩৭ জন যোদ্ধা। এছাড়া এখানে বেশকিছু জাপানিজ সৈন্যকেও সমাহিত করা হয়েছে। বাহিনী অনুযায়ী এখানে ৩ জন নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক এবং ১৬৬ জন বৈমানিক রয়েছেন। যুদ্ধে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের ৩৫৭, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের ৪, দক্ষিণ আফ্রিকার ১, অবিভক্ত ভারতের ১৭৮, জিম্বাবুয়ের তিনজন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, মিয়ানমারের ১, বেলজিয়ামের ১, পোল্যান্ডের ১ ও জাপানের ২৪ জন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংগঠন কমনওয়েলথ গ্রেইভস কমিশনের তত্ত্বাবধানে এই সমাধিক্ষেত্র পরিচালিত হয়।

রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা জানান, সমাধিস্থলে ১৩ দেশের ৭৩৭ সেনাকে সমাহিত করা হয়। তবে সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ৮১ বছর পর গেল ২৪ সালের সেপ্টেম্বর জাপানিজ ২৪ সেনার দেহাবশেষ সরিয়ে জাপানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমান ময়নামতী সমাধিস্থলে শুয়ে আছেন ১২ দেশের ৭১৩ জন সেনা।

কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন সূত্র জানায়, বার্মায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য কুমিল্লার ময়নামতীতে স্থাপন করা হাসপাতালে আনা হতো। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া সৈনিকদের সমাহিত করতে সমাধিস্থলের প্রয়োজন হয়। কাছেই সেনানিবাস, হাসপাতাল ও সৌন্দর্যের কারণেই ময়নামতী ওয়ার সিমেট্রির ওই স্থানকে সমাধিস্থল হিসাবে বাছাই করা হয়।

সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি তোরণ। যার ভেতরের দেওয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাসসংবলিত একটি ফলক ইংরেজি ও বাংলায় লিপিবদ্ধ করে দেওয়ালে স্থাপন করা হয়েছে। এই তোরণ পেরিয়ে সামনে এগোলেই প্রশস্ত পথের দুপাশে দেখা যাবে সারি সারি সমাধিফলক। সেনাদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের সমাধিফলকের নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক চিহ্নিত করা আছে। পুরো সমাধিক্ষেত্রটি সবুজ বৃক্ষরাজি দ্বারা আচ্ছাদিত। আর প্রতিটি সমাধির চারপাশে বিভিন্ন বর্ণিল ফুলের শোভা। সমাধিক্ষেত্রের সামনের অংশের প্রশস্ত পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ২৩টি কবর ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি মূলত ২৩ জন বিমান সেনার একটি গণকবর। প্রশস্থ পথ ধরে সোজা সামনে রয়েছে সিঁড়ি দেওয়া বেদি, তার ওপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুপাশে রয়েছে আরও দুটি তোরণ ঘর। এসব তোরণ ঘর দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পেছনদিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরও অনেক সমাধি। প্রকৃতির নান্দনিক শোভা এই ওয়ার সিমেট্রিকে আরও সুশোভিত করে তুলেছে।

হবিগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা আবুল বাসার ভূঁইয়া বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি নিদর্শন এখানে রয়েছে। একদিকে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোরম, অন্যদিকে যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এখানে এসে হৃদয়বিদারক অনুভূতি জাগায়। একইভাবে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা হিম কৃষ্ণ বলেন, যুদ্ধের ইতিহাস পড়েছি; কিন্তু এখানে এসে সেই ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে অভিভূত।

রাজশাহী থেকে আসা গোলাম কিবরিয়া পিনু বলেন, এখানে যুক্তরাজ্য, ভারত, আফ্রিকা, জাপানসহ নানা দেশের সৈনিকের সমাধি রয়েছে। যুদ্ধের পরিণতি এখানে এসে আরও স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।

তিনি আরও বলেন, এই গণকবর আমাদের শিক্ষা দেয়, দিনশেষে যুদ্ধের ফল কখনো ভালো হতে পারে না।

এদিকে ময়নামতী সমাধিস্থলে প্রতিবছরের নভেম্বরে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা উপস্থিত হয়ে নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। এছাড়া বিভিন্ন সেনাদের আত্মীয়-পরিজনরাও এখানে আসেন তাদের প্রিয়জনের সমাধি দেখতে। নিয়ে যায় সমাধির ছবি, যা শুধু স্থির ক্যানভাসেই দৃশ্য।

চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কুমিল্লার প্রত্নতাত্ত্বিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা বলেন, ঐতিহাসিক ময়নামতী ওয়ার সিমেট্রি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনাদের সমাধিস্থল হলেও এর সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করছে। শালবনবিহার, জাদুঘরসহ কুমিল্লা প্রাচীন নিদর্শনগুলোর সঙ্গে পর্যটকরা ঘুরতে আসেন সমাধিস্থলেও। তবে এখানে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা এবং নিরাপদ রাত্রিযাপনের মতো হোটেল-মোটেলের অভাব রয়েছে। কোটবাড়ী, ময়নামতী এলাকায় সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে হোটেল, মোটেল গড়ে উঠলে দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীদের আগমন বাড়বে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *