Bangla Tribune
গত কয়েক বছর ধরেই ময়মনসিংহে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে সংকট চলছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিল্প বাণিজ্য পরিচালনা করা আরেকটু কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে নতুন শিল্প স্থাপন বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও এখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যবসায়ী নেতা ও উদ্যোক্তারা বলছেন, গত অর্থবছরটি ছিল ব্যবসায়মন্দাভাব। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে আবাসন খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি নেই। নতুন প্রকল্প ও প্রস্তুত রেডি ফ্ল্যাটের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে।
ফ্ল্যাট বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে
দ্য ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মো. মুনসুর আলম চন্দন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সব সময় ময়মনসিংহে সব দলের রাজনীতিবিদের মধ্যে সুসম্পর্ক আছে। এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারা অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। যারা আছে তারাও অনেকটাই চুপচাপ। এ কারণে পুরো বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই ভালো। তবে অর্থনৈতিক অস্থিরতা কাটেনি। পুরো বছর খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসতে আরও সময় লাগবে। কারণ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হতে সময় লাগে।’
এখানে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় আছে আবাসন খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য উল্লেখ করে মুনসুর আলম চন্দন আরও বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছর আবাসন খাতে ফ্ল্যাট বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মালিকরা বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে তারা ঋণখেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যেও গতি নেই।’
ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে খারাপ সময় যাচ্ছে বলে জানালেন ময়মনসিংহ দোকান মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম বজলুর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত অর্থবছর ব্যবসা-বাণিজ্য আরও খারাপ অবস্থায় পড়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল না থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। একটা আতঙ্ক নিয়ে ব্যবসায়ীরা কাজকর্ম করছেন। বেচাকেনা ভালো না হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় অনেকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’
গত বছরের আগস্টের পরে ভালুকা শিল্পাঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং দখলবাজির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ভালুকার গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে ভালুকা শিল্পাঞ্চলে অনেক হামলা এবং দখলবাজির ঘটনা ঘটেছে। এখনও অস্থিরতা কাটেনি। এ কারণে অনেক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী লোকসানে পড়েছেন। অনেক গার্মেন্টস মালিক কর্মী ছাঁটাই করেছেন। এ কারণে অনেক গার্মেন্টসকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এক বছর পার হয়ে গেলেও এখনও গার্মেন্টস শিল্প ও কলকারখানায় স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরে আসেনি।’
পরিস্থিতি উত্তরণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আইনজীবী এ এইচ এম খালেকুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের শাসনামলে মানুষের মাঝে বিক্ষুব্ধতা ছিল। এ বিক্ষুব্ধতার কারণে গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। তাদের পতনের পর মানুষের মাঝে বড় আশা ছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হবে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে। কিন্তু পরে দেখা গেলো প্রশাসন ও পুলিশ একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লো। অনেকে পালিয়ে গেলো। সে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ ও প্রশাসন শক্তিশালীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। কারণ আওয়ামী লীগের স্বৈরাচার সরকারকে সমর্থন দিয়ে জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ অবস্থায় একটা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি ভালো না থাকে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকে; তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে সবাইকে সংযত হতে হবে। স্বার্থের কথা না ভেবে রাষ্ট্রের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক
জেলা পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটেছে। গণঅভ্যুত্থানের পর স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিছুটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। পুলিশ প্রশাসন এর বাইরে নয়। জেলায় শুরুতে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও পরে পুলিশ সেগুলো শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ জন্য সারা দেশের তুলনায় ময়মনসিংহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং আছে। এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সহায়তা করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় আছে।’