Google Alert – প্রধান উপদেষ্টা
মঙ্গলবার (১৯ই আগস্ট) বিকেলে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিহত তিন শিক্ষকের পরিবারের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় দেখা করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বেশ কিছুদিন পার হলেও এই স্মৃতি এখনো সবার মধ্যে দগদগে হয়ে আছে। আমি ঘটনা জানামাত্রই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনারা যে দুঃসময়ের মধ্যে ছিলেন, সে সময়ে দেখা করা সমীচীন হতো না। আমরা আপনাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু এই দুঃসহ স্মৃতি মুছে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, এ শোক আপনাদের একার নয়। জাতি হিসেবে আমরা এই শোককে ধারণ করি।’
এ সময় তিন শিক্ষকের পরিবারের কাছে তাঁদের স্মৃতিকথা শুনতে চান অধ্যাপক ইউনূস। মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল বলেন, ‘তাকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল, তখন ফোনে আমার সাথে কথা হয়। সেদিন বার্ন ইনস্টিটিউটে যে দৃশ্য দেখেছি, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। জীবনে যেন কারও সেই অভিজ্ঞতা না হয়। আমি তাকে দেখলাম, একপাশ পুরোটা পুড়ে গেছে। সেখানে কয়েকজন সামান্য দগ্ধ বাচ্চা চিকিৎসা নিতে নিতে আমাকে বলল, “মিসই আমাদের টেনে টেনে বের করে আনল! মিস তো সুস্থ ছিল! এমন হলো কেন!” আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বের হয়ে এলে না কেন? তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না?” সে আমাকে বলল, “ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?” পৃথিবীর সকল মানুষ ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে তার জন্য দোয়া করেছে। সবার জন্যই সে নিবেদিত প্রাণ ছিল।’
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ২৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৪ আগস্ট মারা যান মাহফুজা খাতুন। মায়ের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা। তিনি বলেন, ‘আমার মা অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আমি ভেবেছিলাম, মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরব। মাকে যেদিন হুইলচেয়ারে বসাই সেদিন মনে হলো আমি বিশ্ব জয় করেছি। মা ছাড়া একেকটা দিন আমার স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমার তো বাবা নেই, এখন মা-ও চলে গেল। আমি এতিম হয়ে গেলাম। এখন পর্যন্ত নিজের বাসায় ফিরতে পারিনি। মা ছাড়া সে বাসায় ফিরব কী করে?’
মাসুকা বেগমের ভগ্নিপতি খলিলুর রহমান বলেন, ‘দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অনেক দিন ধরেই তার (মাসুকা) বোন অসুস্থ। চোখে কিছুটা কম দেখেন। মাসুকা সব সময় তার বাবা ও বোনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, তাঁদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা ছিল। বাবাকে নিয়মিত হাতখরচ পাঠাত। আমার ছেলেমেয়েদেরও নিজের সন্তানের মতো মনে করত। প্রতিদিন তাঁদের সঙ্গে ওর কথা হতো। আমরা আর তার স্কুল-এই ছিল তাঁর জীবন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তাঁদের কথা শুনতে কষ্ট লাগে। একই সঙ্গে গর্ববোধ হয় যে আমাদের দেশে এমন নাগরিক আছে, যারা অন্যের জীবন বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। মানবতার এই দৃষ্টান্ত তারা প্রমাণ করে গেছে। আমরা ক্ষুদ্র মানব ছিলাম, তারা আমাদের বড় করেছে। সবার ভেতরে নাড়া দিয়েছে। সবাই এটা নিজের মধ্যে অনুভব করেছে, “আমি যদি সেই অবস্থানে থাকতাম, আমি কী করতাম? আমি কি জীবনের পরোয়া না করে এভাবে ছোট শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে আত্মবিসর্জন দিতাম?” এই প্রশ্ন সবার মনে এসেছে। এই শিক্ষকগণ আমাদের গর্ব, আমাদের আদর্শ। তাঁদের স্মৃতি আমাদের ধরে রাখতে হবে। এ জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, আমরা তা করব।’
এ সময় মাহেরীন চৌধুরীর দুই ছেলে আদিল রশিদ ও আয়ান রশিদ, বোন মেহেতাজ চৌধুরী, ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী ও নিকটাত্মীয় কাওসার হোসেন চৌধুরী; মাসুকা বেগমের বোন পাপড়ি রহমান; মাহফুজা খাতুনের বোন মুরশিদা খাতুন, ভাগনে মো. মাইদুল ইসলাম ও নিকট আত্মীয় হুমায়ূন কবির উপস্থিত ছিলেন।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার এসডিজি–বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদও উপস্থিত ছিলেন।
ডিবিসি/এফএইচআর