Google Alert – সশস্ত্র
ভারতের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা এবং আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদেরকে মাওবাদী বিদ্রোহী ও সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যকার ‘ক্রসফায়ারে’ আটকা দেখছে।
কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন ভারতে প্রায় ছয় দশক ধরে চলছে, কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার প্রাণ।
সরকারি ভাষ্যে এই বাম চরমপন্থা (এলডব্লিউই) শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের এক সশস্ত্র বিদ্রোহ থেকে, ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি এটি ভারতের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
২০০৯ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একে দেশের ‘অভ্যন্তরীণ সবচেয়ে বড় হুমকি’ আখ্যা দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
গত বছর ভারতের সরকার মাওবাদীদের এ বিদ্রোহের ইতি টানতে ২০২৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ‘ডেডলাইন’ ঠিক করেছে, সে লক্ষ্যে তারা দমিয়ে রাখার ‘নির্দয়’ কৌশলের অংশ হিসেবে নিরাপত্তা অভিযানও জোরদার করেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৬০০-র বেশি সন্দেহভাজন বিদ্রোহী নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টাল (এসএটিপি)। এ নিহতদের মধ্যে নিষিদ্ধঘোষিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) ঊর্ধ্বতন কয়েক নেতাও আছেন।
মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে নিয়ন্ত্রণ জোরদারে সরকার বিশেষ করে ছত্তিশগড়ে ডজনের বেশি নতুন নিরাপত্তা ক্যাম্পও স্থাপন করেছে। ভারতের মধ্যাঞ্চলীয় এ রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই আদিবাসী এবং তারা ঘন জঙ্গলের অনেক ভেতরে বসবাস করেন।
এই দমনপীড়নের মধ্যে বিদ্রোহীরা এ বছরের শুরুর দিকে জানায় যে তারা শর্তসাপেক্ষে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় প্রস্তুত।
কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। মাওবাদীরা অস্ত্র সমর্পণ করলেই কেবল আলোচনা শুরু হবে, চাইছেন তারা।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান কেবল প্রয়োজনীয়ই নয়, বেশ কার্যকর বলেও মনে হচ্ছে, বলছেন কর্মকর্তারা।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মাওবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযান চালিয়েছে তা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, আর বিদ্রোহী নিহত হয়েছে ৫ গুণ বেশি।
কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা এসব অভিযানে সাধারণ মানুষও মারা পড়ছে বলে সন্দেহ করছেন এবং উদ্বেগ জানিয়েছেন।
বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র ও অনুন্নতই থেকে গেছে। সেসব এলাকার সাধারণ মানুষ বিশেষত আদিবাসী সম্প্রদায়কেই এর বোঝা সবচেয়ে বেশি টানতে হচ্ছে।
ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলার পেকারাম মেত্তামি তার ২০-এর ঘরে বয়সী ছেলে সুরেশকে হারিয়ে শোকে কাঠ হয়ে আছেন। পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ আছে সন্দেহে মাওবাদী বিদ্রোহীরা জানুয়ারিতে তাকে হত্যা করেছিল। যদিও ওই যোগসাজশের অভিযোগ সুরেশের পরিবার, পুলিশ এবং স্থানীয়রা অস্বীকার করছেন।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া সুরেশ ছিলেন তার গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত বাসিন্দা, তার চাওয়া ছিল স্থানীয়দের জন্য স্কুল আর হাসপাতাল।
“তার একমাত্র চাওয়া ছিল তার লোকজনের জন্য ভালো সুবিধা, আর সেটাই তার প্রাণ কেড়ে নিল,” বলছেন বাবা পেকারাম।
১০০ মাইল দূরের বিজাপুরের অর্জুন পোতাম কাঁদছেন ভাই লাচ্চুর জন্য। ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে লাচ্চু মারা পড়েন।
পুলিশ বলছে, অভিযানে ৮ মাওবাদী নিহত হয়েছে। কিন্তু অর্জুন পোতাম বলছেন, নিহতরা সবাই ছিলেন নিরীহ।
“যারা মারা পড়েছে তাদের কাছে কোনো অস্ত্রই ছিল না। কয়েকজন এমনকি আত্মসমর্পণও করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ শোনেনি।
“তার (লাচ্চু) পুলিশ, মাওবাদী সবার সঙ্গে খাতির ছিল। কিন্তু সে কখনোই অস্ত্র তুলে নেয়নি,” বলেছেন অর্জুন।
বস্তারের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সুন্দররাজ পি এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে (বেসামরিকদের সঙ্গে) অন্যায়ের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।”
কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে সাধারণ নিরীহ মানুষের মারা পড়ার ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে।
মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে অবশ্য সশস্ত্র বিদ্রোহী ও বেসামরিক বাসিন্দাদের মধ্যে পার্থক্য করাও বেশ কষ্টকর।
২০২১ সালে সুকমা জেলায় নতুন একটি নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ৫ আন্দোলনকারী নিহত হন বলে ভাষ্য স্থানীয়দের।
অন্যদিকে পুলিশ বলছে, বিদ্রোহীদের উসকে দেওয়া এক ‘মবের’ হামলার মুখে পড়েছিল তারা। কিন্তু গ্রামবাসীদের দাবি, কর্মকর্তারা যেন নিরাপত্তা ক্যাম্পে পৌঁছাতে না পারেন সেজন্য বিক্ষোভকারীরা কেবল বিভিন্ন রাস্তা আটকে দিয়েছিল।
“আমার স্বামীর গায়ে বুলেট লাগার পরই কেবল তারা তাকে মাওবাদী আখ্যা দেয়,” বলেছেন উরসা নন্দী। তার স্বামী উরসা ভীমা ওই নিহতদের মধ্যে ছিলেন।
এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত করতে আদেশ দেওয়া হয় বলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ওই তদন্তের ফলাফল কী, সে বিষয়ে বিবিসি জেলা পুলিশপ্রধান ও সেখানকার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের দিক থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভারতের সরকার বলছে, মাওবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির সফলতা মিলছে।
স্থানীয়রা এবং আত্মসমর্পণ করা মাওবাদীদের নিয়ে গঠিত ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড (ডিআরজি) নিরাপত্তা বাহিনীকে বিদ্রোহীদের কৌশল ও গোপন আস্তানা শনাক্তে সহায়তাও করছে, জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
মানবাধিকার কর্মীরা স্থানীয়দের এ ধরনের বাহিনীতে নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তারা এর আগে স্থানীয় রিক্রুটের ওপর নির্ভরশীল অধুনা-বিলুপ্ত স্পেশাল পুলিশ অফিসার্স (এসপিও) বাহিনী নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছিলেন।
২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট ছত্তিশগড় রাজ্যকে এসপিও বাহিনীকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে একে বিলুপ্ত করার নির্দেশ দেয় এবং সতর্ক করে বলে, আদিবাসীদের থেকে রিক্রুট করাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে তাদেরকে বিদ্রোহীদের সামনে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হচ্ছে।
আদালতের আদেশে এসপিও-তে আদিবাসীদের নেওয়া বন্ধ হলেও ডিআরজিতে স্থানীয় তরুণদের নেওয়া চলছে, যাদের মধ্যে একসময়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে ছিল এমন অনেকেই আছেন।
২৮ বছর বয়সী গণেশ (পরিবর্তিত নাম) তাদেরই একজন। তিনি গত বছর বিদ্রোহী হিসেবে আত্মসমর্পণ করেন এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডিআরজিতে যোগ দেন। এখন পর্যন্ত ‘কোনো প্রশিক্ষণ নেওয়া ছাড়াই’ তিনি বিদ্রোহ দমন অভিযানে অংশও নিচ্ছেন।
পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, অভিযানের আগে সবাইকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মানবাধিকারকর্মীরা আগে বিদ্রোহী ছিল এমন ব্যক্তিদের হাতে ফের অস্ত্র তুলে না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
এসপিও-তে আদিবাসীদের নিয়োগ দেওয়ার বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন জানানো লেখক ও শিক্ষাবিদ নন্দিনী সুন্দর বলছেন, আত্মসমর্পণ করা বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে ‘একটি মর্যাদাবান রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া’ হতে পারে বলা যে ‘আসো এবং বেসামরিক হিসেবে স্বাভাবিক জীবন কাটাও’।
ভারতের সরকার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে স্থানীয়দের সমর্থন পেতে নানান প্রণোদনাও দিচ্ছে। সব মাওবাদীরা আত্মসমর্পণ করেছে এমন গ্রামগুলোর উন্নয়নের জন্য ১ কোটি রুপির তহবিল করা হয়েছে। বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নতুন স্কুল, রাস্তা ও মোবাইল টাওয়ার বসানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু স্থানীয়রা আবার এসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তাদের ভয় এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তারা জমি হারাবে ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, যে বনের ওপর তারা নির্ভরশীল তাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখবে।
এসব আশঙ্কাই স্থানীয়দের অনেককে মাওবাদীদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, বলেছেন বস্তারের এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য ২৬ বছর বয়সী আকাশ কোরসা।
সরকারের পক্ষে মার্চের মধ্যেই মাওবাদীদের পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরাও।
ছত্তিশগড়ের সাবেক পুলিশপ্রধান আরকে ভিজ বলছেন, আনুষ্ঠানিভাবে যেগুলোকে মাওবাদী-মুক্ত জেলা ঘোষণা করা হচ্ছে সেখানেও ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে যাচ্ছে।
সরকার আর মাওবাদী, দুই বয়ানের মধ্যে আটকা পড়ে কয়েক দশক ধরে চলা সংঘাত-সংগ্রামে স্থানীয়দেরই সবচেয়ে বেশি মূল্য চুকাতে হচ্ছে।
“আমাদের সবচেয়ে অন্ধকার মুহূর্তেও আমরা কখনোই সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাইনি। এখন মাওবাদীরাও আমাদের সাহায্য করা বন্ধ করে দিয়েছে,” বলেছেন উরসা নন্দী।