মিয়ানমারের জাতীয় ভাগ্যে কালিমা যেসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড

Google Alert – সামরিক

মিয়ানমারের ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড একটি ধারাবাহিক ট্র্যাজেডির মতো, যা দেশটির সম্ভাব্য গতিপথকে বারবার রক্তাক্ত মোড়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্ত থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক দশক পর্যন্ত জাতি গঠনের পথে যারা নেতৃত্ব দিতে পারতেন, সেই সৎ, দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল নেতারা বারবার নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। এর ফলে মিয়ানমার বারবার সুযোগ হারিয়েছে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার।

১৯ জুলাই ১৯৪৭ মিয়ানমারের ইতিহাসের এক ঘোরতম কালো দিন। জেনারেল অং সান এবং তার ছয় মন্ত্রিসভার সদস্যকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, স্বাধীনতার মাত্র ছয় মাস আগে। এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন গ্যালন উ স, যার পরিকল্পনার বলি হয়ে ১৩টি বুলেটে অং সান নিহত হন। এই মুহূর্তেই জাতি হারিয়ে ফেলে একটি সম্ভাব্য গতিশীল, ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় নেতৃত্বের সুযোগ। অং সান-এর স্থানে প্রধানমন্ত্রী হন উ নু, যিনি এই দায়িত্ব পালনে দূরদর্শিতা ও দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হন। ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণ এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা তার নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে তোলেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী হত্যাকাণ্ড : জাতীয় একতার পথে বারবার ছুরিকাঘাত

মিয়ানমারে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরও রাজনৈতিক হত্যা থেমে থাকেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রী উ টিন টুটকে হত্যা করা হয় মাত্র কয়েক মাস পরে। তিনি অং সানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন এবং স্বাধীনতা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। নিউ টাইমস অফ বার্মা অফিস থেকে বের হওয়ার সময় তার উপর হামলা করা হয়। হত্যাকারীর পরিচয় জানা না গেলেও সন্দেহের তীর ছিল সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থদের দিকে।

এরপর একে একে খুন হন ক্যারেন নেতা সাও বা উ গি (১৯৫০), প্রেসিডেন্ট সাও শো থাইক (১৯৬২), শান রাজপুত্র সাওফা সাও কেয়া সেং (নিখোঁজ), বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা থাকিন থান তুন (১৯৬৮) এবং কাচিন নেতারা জাউ সেং ও জাউ তু (১৯৭৫)। এসব হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলোর পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।

যদি ইতিহাসের মোড় অন্যরকম হতো…

প্রশ্ন ওঠে, যদি এসব হত্যাকাণ্ড না ঘটতো, কিংবা যদি কিছু অশুভ নেতাকে সফলভাবে থামানো যেত, তাহলে কি মিয়ানমার আজকের চেহারাটাই ভিন্ন হতো? ধরা যাক, ক্যাপ্টেন ওহন কিয়াও মিন্ট যদি ১৯৭৬ সালে জেনারেল নে উইনকে হত্যা করতে সফল না হতেন, তাহলে কি মিয়ানমার তখনই স্বৈরতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক পথে হাঁটত? কিংবা যদি জেনারেল অং সান বেঁচে থাকতেন, তাহলে কি জাতিগত সংহতি ও উন্নয়নের জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক ফেডারেল কাঠামো গড়ে উঠতো? এই সম্ভাবনাগুলোর উত্তর হয়তো কখনোই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না। তবে ইতিহাসের ক্ষত থেকে জাতীয় পরিণতির অনেকটাই আঁচ করা যায়।

এই বাস্তবতা সামনে এনে একটি গভীর প্রশ্ন উঁকি দেয়- রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য হত্যাকাণ্ড কি কখনো নৈতিক বা কার্যকর হতে পারে? যারা খুন হন, তারা ছিলেন দেশের সম্ভাব্য পথপ্রদর্শক; আর যারা ক্ষমতায় থাকেন বা ওঠে আসেন, তারা অনেক সময়ই ধ্বংসের ধারক। ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, একের পর এক মূল্যবান নেতৃত্বের রক্তের বিনিময়ে জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে দুঃশাসনের অন্ধকার অধ্যায়।

মিয়ানমারের ইতিহাস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎকে বারবার ধ্বংস করেছে। এসব হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তিকে নয়, বরং একটি জাতিকে তার সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করেছে। এই ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- রাজনৈতিক হিংসা কখনোই একটি টেকসই, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের পথ হতে পারে না। শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং সমানাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নৈতিক নেতৃত্ব এবং জনতার সমর্থনই হতে পারে একমাত্র পথ।

সূত্র : ইরাবতি

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *