মিয়ানমারে ডিসেম্বরে নির্বাচন : জান্তার নতুন কৌশল

Google Alert – সেনাবাহিনী

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে। যা বিশ্লেষকদের মাঝে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। কী সেই পদক্ষেপ? বলা হচ্ছে জান্তা একটি বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। আর ডিসেম্বরে হবে নির্বাচন। সেই পরিকল্পিত জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ সরকার গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দায়িত্বের পাশাপাশি জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। বলা যেতে পারে সেই খোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীকে যে ফরমানের (ডিক্রির) মাধ্যমে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি একটি তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন গঠন করা হয়েছে এবং আসন্ন নির্বাচন তত্ত্বাবধানের জন্য একটি বিশেষ কমিশনও গঠন করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা কী চোখে দেখছেন এই পরিবর্তনকে? তারা বলেছেন, মিয়ানমার জান্তার এ পদক্ষেপে দেশটির ক্ষমতাকাঠামো পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত নেই। কারণ, সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা মিন অং হ্লাইং এখনো ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধানের পদও ধরে রেখেছেন। তিনি কী করতে চাইছেন আর দেশের বিবদমান পক্ষগুলো এসব পদক্ষেপ কিভাবে নেবেন তা এখন দেখার বিষয়।

সরকারের মুখপাত্র জাও মিন তুন জানান, অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, গতকাল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা জারির পর তা সাতবার নবায়ন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমকে এই মুখপাত্র বলেন, অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান বলেছেন, আগামী ছয় মাস নির্বাচনের প্রস্তুতি ও আয়োজনের সময় হিসেবে বিবেচিত হবে।

২০২১ সালে নির্বাচিত নেতা অং সান সু চির সরকারকে উৎখাতের পর থেকে মিয়ানমার চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে। তখন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে। সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখো মানুষ। সেখানে কার্যত এখন তিনটি প্রশাসন রয়েছে। আর পুরো দেশের উপর জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের অর্ধেকেরও বেশি এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বিরোধী একাধিক পক্ষ।

ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পলিসির এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, জান্তা বাহিনী স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) মিয়ানমারের ৫০ শতাংশেরও কম নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে ৭৭ শতাংশ প্রধান শহর অন্তর্ভুক্ত। নির্বাসিত জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রতি অনুগত জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন (ইএওএস) এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সমন্বয়ের ফলে বেশ কয়েকটি বৃহৎ শহরতলিসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাতবদল দেখা গেছে। এতে বলা হয়, জান্তাবিরোধী বাহিনীর অব্যাহত এবং টেকসই সাফল্য এবং তাদের অভূতপূর্ব সমন্বয় মিয়ানমারের প্রতিবেশীদের অবাক করে দিয়েছে। চীন দেখেছে যে মিয়ানমারের সাথে প্রায় সব সরকারি বাণিজ্য পোস্ট জান্তাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের স্থলসীমান্ত এখন সম্পূর্ণরূপে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

বিবিসির ২০২৪ সালে করা তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে, জান্তার ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের চার বছর পর মিয়ানমারের সামরিক সরকার দেশের মাত্র ২১ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে বিদ্রোহী বাহিনী এবং জাতিগত সেনাবাহিনী দেশের ৪২ শতাংশ দখল করেছে, পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এবং এর মিত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড দখল করতে চলেছে, বার্মার কেন্দ্রস্থলে সেনাবাহিনীকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে এবং মান্দালয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে যে, এই সঙ্ঘাতের ফলে ত্রিশ লাখেরও বেশি বেসামরিক লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং পঁচাত্তর হাজারেরও বেশি লোক মারা গেছে। সম্প্রতি কিছু কিছু এলাকা জান্তাবাহিনী পুনরুদ্ধার করেছে বলেও খবর আছে। হত্যা ও নির্যাতনের এসব অভিযোগ কিন্তু জান্তা সরকার অস্বীকার করেছে। ক্ষমতাচ্যুত এনএলডি নেত্রী ও সাবেক স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিসহ কয়েকটি বিরোধী দল প্রবাসী সরকার গঠন করেছে। যদিও সু চি এখন গৃহবন্দী।

মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচন পশ্চিমা সরকারগুলো প্রহসন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, এই নির্বাচন জেনারেলদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার উপায় ছাড়া কিছু নয়। নির্বাচনে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট দলগুলোই প্রভাব বিস্তার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন বিশ্লেষক ডেভিড ম্যাথিসন বলেন, ক্ষমতায় যে রদবদল করা হয়েছে, তা লোকদেখানো। যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা আগের মতোই অত্যাচারী ও দমনমূলক আচরণ চালিয়ে যাবেন। বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই নির্বাচনের উদ্দেশ্য মূলত সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আরো শক্তিশালী করা।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জান্তা সরকার মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে জরুরি অবস্থা জারি করে। এর ফলে দেশজুড়ে এক বহুমাত্রিক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এতে হাজারো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। জরুরি অবস্থার আওতায় জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং নির্বাহী, বিচার, আইন বিভাগসহ রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। তবে সম্প্রতি তিনি সঙ্ঘাত নিরসনের উপায় হিসেবে নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। সেনা অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া সাবেক আইনপ্রণেতাসহ দেশটির বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন হলেও সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং প্রেসিডেন্ট কিংবা সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান হিসেবে থেকে যাবেন এবং সেই পদ থেকেই বাস্তবে দেশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবেন। এরই মধ্যে একাধিক ঘোষণার মাধ্যমে একটি নতুন ‘ইউনিয়ন সরকার’ এবং ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তি কমিশন’ গঠনের কথা জানানো হয়েছে, যা প্রতিরক্ষা ও নির্বাচন প্রক্রিয়া তদারকি করবে। এগুলোর নেতৃত্বে থাকবেন মিন অং হ্লাইং নিজেই। তিনি আপাতত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

মিয়ানমার নামে একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র হলেও দেশটির রাজনীতি গোলযোগময়। দীর্ঘ সময় দেশটি সামরিক শাসনে থেকেছে, এখনো আছে। সর্বশেষ ২০২১ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাদো দেশটির রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা খাতে আধিপত্য কায়েম করে আছে। দেশের বাজেটের ১৫ শতাংশই সামরিক খাতে বরাদ্দ করা হয়। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক ইতিহাস বিদ্যমান। নৃগোষ্ঠীগত সঙ্ঘাত, সামরিক দমনপীড়ন ও পৌর এলাকাগুলোতে অপরাধের উচ্চহার জনগণের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক। মিয়ানমার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের অংশ বিধায় ব্যাপক মাদক চোরাচালান ঘটে, যা সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ ও অস্থিতিশীলতাকে উসকে দেয়। সহিংসতার কারণে বিপুল বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য সরকারি সহায়তা খুবই সীমিত। রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা রোাহিঙ্গারা রয়েছে বাংলাদেশে। এ নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হলেও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি মোটেই আগায়নি। মিয়ানমার আসিয়ান ও জাতিসঙ্ঘের সদস্য হলেও দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান। চীনের সাথে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক শীতল।

অং সান সু চির দল এনএলডি ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সংসদের ৮১ শতাংশ আসন পেলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। সু চির দল ২০১০ সালের নির্বাচন বয়কট করে, যা সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় এনে দেয়। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে সু চি সংসদের নিম্নকক্ষের এমপি হন এবং তার দল ৪৫টি ফাঁকা আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করে। ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল বিশাল বিজয় অর্জন করে, অ্যাসেমব্লি অব দ্য ইউনিয়নের (সংসদ) ৮৬ শতাংশ আসন অর্জন করে। সু চির প্রয়াত স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না; তাই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান। গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে সংগ্রামের জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারসহ (১৯৯১) আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন, যদিও রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রসঙ্গে তার ভূমিকা তীব্রভাবে সমালোচিত। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর বর্তমানে তিনি ও তার দলের অধিকাংশ নেতা গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন।

মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য জান্তা সরকার সাড়ে চার বছরের জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করলেও এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দেশটির বিরোধী দলগুলোর অধিকাংশ নেতাই যখন কারাবন্দী তখন এই নির্বাচন কিভাবে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে তা পরিষ্কার নয়। এছাড়া জান্তা সরকারের সাথে চীনের সখ্য ও স্বার্থরক্ষা নিয়েও বিভাজন আছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরবে কি না- এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *