Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল
মো: ওবায়দুল্লাহ
বাংলাদেশে দ্রুত শিল্পায়নের জন্য গত এক দশকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ এই নীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ৩০ হাজার একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই শিল্পনগর ইতোমধ্যেই বিদেশী ও দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইলেকট্রনিক কোম্পানি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবাই এখানে জায়গা নিচ্ছে। কিন্তু একই প্রকল্পের ভেতরে ভারতের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় ৯০০ একরের ‘ইন্ডিয়ান ইকোনমিক জোন’ (IEZ) আজও বাস্তব রূপ পায়নি। কাগজে-কলমে থেকে যাওয়া এই প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন এখন দ্বিমুখী। অর্থনৈতিকভাবে এটি কেন ব্যর্থ হলো? আর ভৌগোলিক ও কৌশলগত দিক থেকে এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি করেছে?
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে প্রথমবার ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ঘোষণা দেয়া হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবে সম্মতি দিলে শুরু হয় আলোচনা। শুরুতে প্রস্তাব ছিল মোংলা বা রামপালে ১০০-৩০০ একর জমির, কিন্তু ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে সেটি এক লাফে বেড়ে যায় এক হাজার একরেরও বেশি। শেষ পর্যন্ত মীরসরাই শিল্পনগরে প্রায় ৯০০ একর জমি ভারতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। দায়িত্বও পায় ভারতের প্রভাবশালী করপোরেট গ্রুপ-আদানি।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেড (APSEZ) একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ২০২২ সালে যৌথ উদ্যোগে শর্তপত্র তৈরি হয়। ভারত এর জন্য সাড়ে ১১ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, কিন্তু সেটি ছিল আসলে ভারতের রফতানি-সহায়ক ঋণ বা Line of Credit (LoC)।
এই ঋণের মূল শর্ত ছিল, ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ অর্থ ভারতের কোম্পানির কাছে খরচ করতে হবে। ফলে বাংলাদেশ আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে সেই অর্থ ফেরত পাঠাচ্ছে ভারতীয় ঠিকাদার ও কনসালট্যান্টদের কাছে। বেজা বারবার স্থানীয় ঠিকাদারদের সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করলেও ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক সাড়া দেয়নি। ফলাফলও অনুমেয় ছিল। দরপত্রে অংশ নেয় মাত্র দু’টি ভারতীয় কোম্পানি- আদানি গ্রুপ এবং ইন্টারন্যাশনাল সিপোর্ট ড্রেজিং। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তারা দু’জনেই সরে দাঁড়ায়। প্রতিযোগিতা না থাকায় প্রকল্প পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়ে।
মীরসরাইয়ের ভৌগোলিক অবস্থান
অর্থনৈতিক দিক বাদ দিলেও, মীরসরাইয়ের ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিশ্লেষক এই অঞ্চলকে বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ বলেন। কারণ, এটি চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার ও পার্বত্য তিন জেলা- রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি যাওয়ার একমাত্র করিডোর। এই করিডোর বন্ধ হয়ে গেলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার কার্যত দেশের মূল ভ‚খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই অঞ্চলকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী বহু বছর ধরে নতুন ঘাঁটি গড়ার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বিবেচনা করছে। তাই এখানে বিদেশী বিনিয়োগকারীর নামে বিশেষ অঞ্চল ঘোষণা করা নিছক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তার সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এ ছাড়াও মীরসরাইয়ের বিপরীতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ত্রিপুরা, আসাম ও মিজোরাম- সবখানেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। যেমন- আগরতলা ক্যান্টনমেন্ট, ত্রিপুরায় একটি বড় ঘাঁটি। করিমগঞ্জে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ লাইন। মিজোরামের লুংলাই এলাকায় রয়েছে সীমান্ত নজরদারি পোস্ট। ভারত শুধু স্থলেই নয়, সমুদ্রপথেও সক্রিয়। আন্দামান-নিকোবর কমান্ড ও বিশাখাপত্তনম নৌঘাঁটি থেকে তারা বঙ্গোপসাগরে দীর্ঘমেয়াদি নজরদারি চালায়। ফলে মীরসরাই ভারতের সামরিক কৌশলগত পরিধির ভেতরেই পড়ে। এ অবস্থায় ভারতীয় কোম্পানির হাতে মীরসরাই শিল্পনগরের ৯০০ একর জমি দীর্ঘমেয়াদে লিজ দেয়া মানে হলো কৌশলগতভাবে ভারতের উপস্থিতিকে এক ধরনের স্থায়ী রূপ দেয়া। জমি বিক্রি করা হয়নি, কিন্তু ৫০ বছরের লিজ কার্যত জমিকে অচল করে রেখেছে।
শিল্পায়ন বনাম কৌশলগত ঝুঁকি
বাংলাদেশের জন্য মীরসরাই শিল্পনগর শিল্পায়নের প্রতীক হলেও, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরাপত্তার ঝুঁকি। প্রথমত, করিডোর নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি। এই সঙ্কীর্ণ উপক‚লীয় করিডোর অবরুদ্ধ হলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ভ‚রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। কক্সবাজারে চীনের সহায়তায় পোর্ট উন্নয়ন চলছে, অন্য দিকে মীরসরাইয়ে ভারত অঞ্চল চেয়েছিল। ফলে এ অঞ্চল হয়ে উঠছে ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন কেন্দ্র। তৃতীয়ত, নৌবাহিনীর পরিকল্পনা ব্যাহত হয়েছে। জমি দীর্ঘমেয়াদে আটকে থাকায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী সম্ভাব্য ঘাঁটি স্থাপন করতে পারছে না।
মীরসরাই প্রকল্প দেখিয়ে দিলো, দেশভিত্তিক অঞ্চল ও শর্তযুক্ত ঋণ একসাথে এলে উন্নয়নের বদলে স্থবিরতা তৈরি হয়। সার্বভৌম মালিকানা কাগজে থাকলেও বাস্তবে জমি কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অন্যান্য অঞ্চল ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি কিংবা স্থানীয় তৈরী পোশাক শিল্প ইতোমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে। সেখানে খোলা প্রতিযোগিতা ছিল, দেশভিত্তিক ট্যাগ ছিল না, অর্থায়নও ছিল বহুমুখী। ফলে বিনিয়োগ এসেছে এবং শিল্পায়ন এগোচ্ছে। পার্থক্য এখানেই- স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা থাকলেই সাফল্য আসে।
করণীয় কী
বাংলাদেশের এখন করণীয় হলো দেশভিত্তিক ট্যাগ বাদ দেয়া। মীরসরাইয়ের ৯০০ একর জমিকে খাতভিত্তিক বিশেষ অঞ্চল হিসেবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে। যেমন- নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ইলেকট্রনিক বা অটোপার্টস খাতে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডেকে বিনিয়োগ আনা যেতে পারে।
এ ছাড়া অর্থায়নের কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি। ভারতের শর্তযুক্ত ঋণ কার্যকর না হলে নিরপেক্ষ উৎস, যেমন- বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা অন্যান্য বহুপক্ষীয় সংস্থা থেকে অর্থায়ন খুঁজতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াকে করতে হবে স্বচ্ছ। চুক্তি, দরপত্র ও উন্নয়ন সূচি প্রকাশ্যে আনতে হবে। একই সাথে স্থানীয় ঠিকাদার, শ্রমিক ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের শর্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে।
মীরসরাইয়ের ‘ইন্ডিয়ান ইকোনমিক জোন’ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য এক বড় শিক্ষা। শিল্পায়নের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও যদি তা সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে, তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো মানে হয় না। আজ ৯০০ একর জমি আটকে আছে, বিনিয়োগ হয়নি, কাজ শুরু হয়নি।
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সামনে এখন প্রশ্ন স্পষ্ট, আমরা কি শিল্পায়নের নামে জমি অচল করে রাখব, নাকি জাতীয় নিরাপত্তা ও শিল্পোন্নয়নকে একসাথে সমন্বিত করব?
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপিতে উচ্চশিক্ষারত