Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল
মেঘভাঙা বৃষ্টি ও আকস্মিক বন্যায় বিধ্বস্ত ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশী। তীব্রবেগে ধেয়ে আসা ক্ষীরগঙ্গা নদীর পানি এবং সঙ্গে বয়ে আসা বড় পাথর আর কাদার স্রোতে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে উত্তরকাশীর ধরালি গ্রামের বিস্তীর্ণ অংশ। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে হর্ষিল উপত্যকা সংলগ্ন অঞ্চলে।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) এই ভয়াবহ ঘটনার এক ঝলক মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ। মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভিডিও ও ছবি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গ্রামের বহু বাড়ি, হোটেল এবং হোমস্টে ওই আকস্মিক বন্যায় ভেসে গেছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে, বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। মৃতদের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন>>
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, কয়েকদিন ধরেই উত্তরাখণ্ডে বৃষ্টি হচ্ছিল। তারই মাঝে মঙ্গলবার মেঘভাঙা বৃষ্টি দেখা দেয়, যার জেরে এই বিপর্যয়।
মেঘভাঙা বৃষ্টি কী?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোনো ছোট এলাকায় (এক থেকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত) এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিপাত হলে সেই ঘটনাকে ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘভাঙা বলে চিহ্নিত করা হয়।
ক্লাউডবার্স্ট-এর কারণে অতিভারী বৃষ্টি দেখা যায়। তবে এর সঙ্গে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পার্থক্য আছে।
একটা ছোট্ট এলাকায় মেঘ হঠাৎ ঘনীভূত হওয়ার কারণে বৃষ্টি দেখা দেয়। এর তীব্রতা এবং প্রভাব স্বাভাবিক অবস্থায় ভারী বা অতিভারী বৃষ্টির চাইতে অনেক বেশি, ক্ষতি করার শক্তিও বেশি।
এই জাতীয় বৃষ্টির ফলে পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়শই আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধস দেখা যায়। তাতে প্রাণনাশ এবং বড় আকারে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে।
কখনো কখনো এক জায়গায় একাধিক মেঘভাঙার ঘটনাও ঘটতে পারে, যেমনটা ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডে হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।
তবে ওই এলাকায় যদি আগে থেকেই যদি কোনো নদী বা লেক থাকে এবং সেখানে পানির পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে আশপাশের আবাসিক এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হয়।
কারণ কী?
আবহাওয়াবিদদের মতে, উষ্ণ বায়ু ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে এলে ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়। উষ্ণ বাতাস ওপরের দিকে উঠতে থাকার কারণে মেঘে সঞ্চিত জলকণা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারে না। বৃষ্টির জলকণাকেও ক্রমে শুষে নিয়ে ওপরে উঠতে থাকে গরম বাতাস।
নিচু অঞ্চল থেকে উচ্চ ভূখণ্ডের দিকে উঠতে থাকার এই প্রক্রিয়াকে ‘অরোগ্রাফিক লিফট’ বলে। এক্ষেত্রে উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে এবং মেঘ তৈরি হয়।
ছোট অঞ্চলে বেশি পরিমাণে মেঘ ঘনীভূত থাকে এবং এক সময় সেই মেঘ আর পানি ধরে রাখতে পারে না। তখন তীব্র গতিতে পানি নেমে আসতে থাকে।
এসময় ভারী থেকে অতি বৃষ্টি দেখা দেয়, যাকে ক্লাউডবার্স্ট বলে। আক্ষরিক অর্থে কোনো ‘বিস্ফোরণ’ হয় না।
পার্বত্য অঞ্চলে সময় এই ঘটনা ঘটলে পানির স্রোতের সঙ্গে পাহাড়ের বড় পাথর, কাদাপানি নেমে এসে বিপর্যয়ের তীব্রতা বাড়ায়। আশপাশে নদী বা লেক থাকলেও বিপর্যয়ের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যেমনটা এর আগে উত্তরাখণ্ডে, সিকিমে ও লাদাখে দেখা গিয়েছিল।
আবহাওয়াবিদদের মতে, ভারতে মনসুন এবং প্রি-মনসুনে মেঘভাঙা বৃষ্টির প্রকোপ দেখা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে মেঘভাঙা বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
সমতলেও মেঘভাঙা বৃষ্টি হতে পারে, তবে পার্বত্য অঞ্চলে এর আশঙ্কা বেশি। কারণ পার্বত্য অঞ্চল অরোগ্রাফিক লিফটের জন্য অনুকূল।
আকৃতিগত কারণে পাহাড় বায়ুপ্রবাহের পথে বাধা হিসেবে কাজ করে। আর্দ্র বাতাসের পথে পার্বত্য অঞ্চল থাকলে বায়ু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি বায়ু শীতল এবং ঘনীভূত হতেও সাহায্য করে।
বাতাস পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রসারিত এবং ঠান্ডা হয়। এর ফলে তার আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। একসময় তা মেঘে পরিণত হয় এবং ঘনীভূত হওয়ার পর অবশেষে বৃষ্টিপাত দেখা যায়।
পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব?
এক থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে অঞ্চলে হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে মেঘভাঙার ঘটনা দেখা যায়। এ কারণে আগাম পূর্বাভাস পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর রাডারের সাহায্যে বিস্তীর্ণ এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিলেও কোন এলাকায় মেঘভাঙা বৃষ্টিপাত হবে তা অনুমান করা কঠিন।
তবে এক্ষেত্রে পূর্বাভাসের জন্য যেসব অঞ্চলে মেঘভাঙার আশঙ্কা প্রবল, সেখানে ঘন রাডার নেটওয়ার্ক প্রয়োজন বা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের অতি উচ্চ-রেজোল্যুশনযুক্ত মডেল প্রয়োজন যা ছোট মাত্রার ঘটনাকেও ক্যাপচার করতে পারে।
তবে আবহাওয়াবিদদের মতে, এক্ষেত্রে ডপলার রাডার সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। ডপলার রাডার দূরবর্তী বস্তুর বেগ সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। কিন্তু হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলের সব জায়গায় এই রাডার নেই।
কোথায় এর আশঙ্কা বেশি এবং কেন?
ভারতের হিমালয় অঞ্চলে চরম আবহাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই তালিকায় মেঘভাঙন, আকস্মিক বন্যা, তুষারধস এবং অতিভারী বৃষ্টিপাত রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ঝুঁকিগুলো আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জম্মুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এবং রুরকির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইড্রোলজির বিজ্ঞানীদের ২০২৩ সালের একটা গবেষণাপত্র ইন্টারন্যাশনাল হ্যান্ডবুক অব ডিজাস্টার রিসার্চে প্রকাশিত হয়েছিল।
সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে হিমালয়ের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তরাখণ্ডে প্রতি ইউনিট এলাকায় মেঘ ভাঙনের প্রবণতা খুব বেশি।
উত্তরাখণ্ডের এই ঘটনার নেপথ্যে তার প্রাকৃতিক ভৌগোলিক অবস্থা এবং মানবসৃষ্ট পরিবেশগত পরিবর্তন দুই-ই রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে ভঙ্গুর অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটা হিমালয় অঞ্চল। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এই অঞ্চলে প্রচুর আর্দ্রতা বয়ে আনে।
হিমালয়ের সংকীর্ণ উপত্যকায়, এই জলের কোথাও ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ থাকে না। এর ফলে প্রায়শই আকস্মিক বন্যা এবং বিপর্যয় দেখা দেয়।
রাস্তাঘাট, বাঁধ এবং ভবনের অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণের ফলে সেখানকার নিকাশি ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি বন কেটে ফেলা এবং ভূমি-ব্যবহারের পরিবর্তন মাটির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে যার ফলে বৃষ্টির পানি শোষণের প্রাকৃতিক ক্ষমতাও কমেছে। এই মানবসৃষ্ট পরিবর্তনগুলোর কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।
অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মৌসুমি বায়ুর ধরণ বদলে গেছে। অনেক সময়ই এর আগমনের পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
গবেষকদের মতে, তাপমাত্রার অসংগতি, বাতাসের ধরণ পরিবর্তন এবং নিম্নচাপের কারণে উত্তরাখণ্ডে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়েছে যা মেঘভাঙনের আশঙ্কা এবং তীব্রতা বাড়িয়েছে।
বিপর্যস্ত ধরালি গ্রাম
উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীর ধরালি গ্রামের বিস্তীর্ণ অংশ মঙ্গলবার মেঘভাঙা বৃষ্টির পর আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ওই গ্রামের কাছে ক্ষীরগঙ্গা নদীর উচ্চ অববাহিকায় মেঘভাঙা বৃষ্টি দেখা যায়। জলস্তর হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ফুঁসতে শুরু করে ওই নদী এবং এর প্রভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধরালি গ্রাম ও সংলগ্ন অঞ্চল। প্রভাবিত হয় হর্ষিল উপত্যকা সংলগ্ন অঞ্চলও।
গঙ্গোত্রী ধামের প্রায় ২০ কিলোমিটার আগে অবস্থিত ধরালি। প্রতি বছর চারধাম যাত্রার সময় বিপুল সংখ্যক ভক্তের সমাগম দেখা যায়।
গত কয়েকদিন ধরেই উত্তরাখণ্ডে বৃষ্টি হচ্ছিল, কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা নাগাদ ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা লক্ষ্য করেন কাদা ও পাথরখণ্ড মিশ্রিত পানির তীব্র স্রোত গ্রামের দিকে ধেয়ে আসছে।
সেই সময় রেকর্ড করা ভিডিওতে উপস্থিত ব্যক্তিদের অন্যদের সতর্ক করে ‘পালাও পালাও’ বলে চিৎকার করতে শোনা যায়। তবে অনেকে পালানোর সুযোগ পাননি।
মুহূর্তে ওই অঞ্চলের বাসভবন, হোটেল, দোকানঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায় আকস্মিক বন্যা।
ধরালি গ্রামের বাসিন্দা আস্থা পাওয়ার এই ভয়াবহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমি ধরালিতে আছি। আমার বাড়ি রাস্তা থেকে একটু দূরে। তাই এখান থেকে সবকিছু দেখা যাচ্ছে, নিচের অংশে কতটা ক্ষতি হয়েছে।
‘আমার চোখের সামনে বহু হোটেল ভেসে যেতে দেখেছি। এমন নয় যে সবকিছু একযোগে ভেসে গেছে। প্রথম যে ঢেউটা এসেছিল তা খুবই শক্তিশালী এবং ভয়াবহ ছিল। তারপরেও, প্রতি ১০-১৫ বা ২০ মিনিট অন্তর ধ্বংসাত্মক ঢেউ আসতে থাকে। ছোট ছোট ঢেউ এসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে হোটেলগুলোকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।’
ধরালি গ্রাম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে হর্ষিলে, ভারতীয় সেনার একটা ক্যাম্প রয়েছে। ঘটনার খবর মেলার পরই সেনাবাহিনীর একটা বড় দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
জেলা প্রশাসন, এনডিআরএফ, স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স, সেনা বাহিনী একযোগে উদ্ধারের কাজ চালাচ্ছে।
এখনো বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন, যাদের মধ্যে সেনাবাহিনীর জওয়ানও রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনীশ শ্রীবাস্তব বলেন, ১৪ রাজপুতানা রাইফেলসের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল হর্ষবর্ধনের নেতৃত্বে ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযানের কাজ চালাচ্ছে।
কর্নেল মনীশ শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন, সেনা ক্যাম্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, হর্ষিলের সেনা ক্যাম্পে পানি প্রবেশ করার পর সেনাবাহিনীর কয়েকজন নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে দুজন ফিরে এসেছেন। বাকি নয়জনের খোঁজ চালানো হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী মঙ্গলবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/