যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: উত্তরণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের হতাশা

Bangla Tribune

যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত পাল্টা শুল্কের মুখে পড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখন গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। এই শুল্ক ১ আগস্ট  থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকার দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানের দিকে এগোচ্ছে এবং আলোচনায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

একযোগে প্রস্তুতি ও কূটনৈতিক তৎপরতা

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) বাংলাদেশের কাছে তিনটি পৃথক ট্যারিফ প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সেগুলোর পর্যালোচনা শেষে দ্রুত জবাব পাঠানো হবে। আগামী শনিবার (১৯ জুলাই) একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অবস্থান চূড়ান্ত হবে।

তিনি বলেন, “এই আলোচনায় আমরা শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এবং রফতানি খাত সংশ্লিষ্ট নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। সরকারের একার পক্ষে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।”

তবে আলোচনার কাঠামো সম্পর্কে সচিব বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি। কারণ উভয়পক্ষ একটি ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এনডিএ) সই করেছে। তিনি বলেন, “বেশির ভাগ শুল্ক প্রস্তাবের বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি।”

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ: এটা মৌসুমি মেঘ নয়, দীর্ঘমেয়াদি ঝড়

পোশাক খাতের নেতারা এই শুল্ক আরোপকে ‘দুঃস্বপ্নের সূচনা’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা এখনও সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পাইনি। তবে যেকোনও সময় আলোচনায় অংশ নিতে আমরা প্রস্তুত।”

স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম জানান, মার্কিন ক্রেতারা ইতোমধ্যে আমাদের ওপর অর্ডারের দর হ্রাসের চাপ দিচ্ছেন। আমরা এক মিলিয়ন শার্ট এমন দামে দিতে বাধ্য হচ্ছি—লাভ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভারত বা ভিয়েতনামে অর্ডার স্থানান্তরের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য এবং প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই শুল্ক আরোপ শুধু বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি (৮০০ বিলিয়ন ডলার) এবং বাজেট ঘাটতি (১.৮৩ ট্রিলিয়ন ডলার) কমানোর বড় কৌশলের অংশ।

২০২৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাক আমদানি ৬০ শতাংশ কমে যাওয়ার পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর দিয়েছে মার্কিন ক্রেতারা। এ অবস্থায় ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো দ্রুত বাজার দখল করছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বাজার অংশীদারত্ব ৯.২ শতাংশ, যেখানে চীন ও ভিয়েতনাম রয়েছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে।

বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া ও অভিজ্ঞতার অভাব

সরকারের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া ও দরকষাকষিতে অভিজ্ঞ নেতৃত্বের অভাব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্কের ঘোষণা দেন। এর পাঁচ দিন পর ৭ এপ্রিল অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সই করা একটি চিঠিতে তিন মাসের জন্য শুল্ক স্থগিত রাখার অনুরোধ জানানো হয়। একই দিনে বাণিজ্য উপদেষ্টার মাধ্যমে ইউএসটিআর’কে আরও একটি চিঠি পাঠানো হয়।

এই চিঠির ভিত্তিতে ট্রাম্প প্রশাসন ৯ এপ্রিল শুল্ক কার্যকরের তারিখ স্থগিত করে ৯ জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু ৮ জুলাই ট্রাম্প ফের ঘোষণা দেন, ১ আগস্ট থেকে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে।

আলোচনার শুরুতে নেতৃত্ব দেন আন্তর্জাতিক-বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি এপ্রিল মাসে ওয়াশিংটনে ইউএসটিআর ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করলেও মে মাসজুড়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি।

জুনে “নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট” সইয়ের মাধ্যমে তথ্য গোপন রাখা হয়, এবং ১৭ জুন অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আনুষ্ঠানিক ভার্চুয়াল আলোচনা।

পরবর্তীকালে আলোচনার দায়িত্বে আসেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং এরপর বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

আলোচনার দ্বিতীয় দফা ও অনিশ্চয়তা

৯-১১ জুলাই ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হলেও ‘এনডিএ’-এর কারণে তা নিয়ে কোনও বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়নি।

৮ জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অধ্যাপক ইউনূসকে চিঠি দিয়ে জানান, বাংলাদেশের ওপর শুল্কহার ৩৭ নয়, ৩৫ শতাংশ হবে। যদিও এটি কতটা সহায়ক হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।

সমালোচনা ও হতাশা

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, “এমন একটি সংকটে সময়মতো আলোচনা শুরু না করায় আমরা আজ অন্ধকারে। কোনও পেশাদার লবিস্টও নিযুক্ত করা হয়নি।”

বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, “গোপনীয়তা ঠিক আছে, তবে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের অবহিত না করা অগ্রহণযোগ্য।”

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, “শুরু থেকেই দরকার ছিল অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী, কূটনৈতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী আলোচক দল গঠন করা।”

সম্ভাব্য সমাধান ও কৌশলগত পথনির্দেশ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখনই প্রয়োজন একটি সময়োপযোগী, বাস্তবভিত্তিক ও সমন্বিত রফতানি কৌশল।

বাংলাদেশ চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক সুবিধাভিত্তিক চুক্তিতে যেতে পারে। যেমন- আমেরিকান তুলা, সয়াবিন, গমের শুল্কমুক্ত প্রবেশ এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য ৩-৫ বছরের ট্রানজিশন পিরিয়ড নিশ্চিত করা।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ শুধুই বাণিজ্যিক ইস্যু নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ। এর মোকাবিলায় সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত, কূটনৈতিক দৃঢ়তা এবং বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

দেশ একটি গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ—এখানে পিছিয়ে পড়ার অর্থ হবে অর্থনীতির এক ভয়াবহ ধস। তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন এক ঐক্যবদ্ধ, কৌশলগত ও বাস্তবভিত্তিক জাতীয় জবাব।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *