যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অদম্য বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি

Google Alert – বাংলাদেশ

যখন ট্রাম্প প্রশাসন হঠাৎ করে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে আমরা সবাই আশঙ্কা করেছিলাম -এই নতুন শুল্কহার বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি, বিশেষ করে পোশাক খাতে বিপর্যয় ডেকে আনবে। তবে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাংলাদেশের প্রতি নমনীয়তা এবং ধাপে ধাপে তা কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত দেশবাসী ও ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনে।

নতুন শুল্কহার আরোপের শঙ্কা ও উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জানুয়ারি – জুন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পণ্য রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা ও শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ, যা বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের অধীন সংস্থা ওটেক্সা (অফিস অফ টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল) এর প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ছয় মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৫.১২ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় ছিল ৩.৩৯ বিলিয়ন ডলার। শুধু জুন মাসেই রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৭২৩ মিলিয়ন ডলারে, যা মে মাসের ৫৪৭ মিলিয়নের তুলনায় ৩২.০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানির পরিমাণও এই সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৩৮.১৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.৭৪ শতাংশ বেশি। পরিমানের দিক কে  আমদানিতে ৪.২৬ শতাংশ এবং প্রতি ইউনিট দামে ২.৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে।

আমরা দেখেছি, ধীরে ধীরে শুল্কহার কমিয়ে আনা হলেও সবচেয়ে বড় শক্তি এসেছে আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে। আমাদের উদ্যোক্তারা হাল ছাড়েননি, শ্রমিকরা গার্মেন্টস কারখানার মেশিনে দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন, আর সরকারও সময়োপযোগী নীতি দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির যে ২৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটল, তা কেবল অর্থনীতির সাফল্য নয় এটি জাতির আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

২০২৫ সালের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রে চীন থেকে পোশাক আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে এবং ১৬.০৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে দেশটির রপ্তানি। এছাড়া, চীনের প্রতি ইউনিট রপ্তানি দামে ৩.৭৭ শতাংশ কমে গেছে এবং পরিমানে কমেছে ১২.৭৮ শতাংশ। এটি চীনের প্রতিযোগিতা শক্তিকে দুর্বল করে তুলেছে।

বাংলাদেশ শুধু মূল্য নয়, ইউনিট সংখ্যার দিক থেকেও চমৎকার অগ্রগতি দেখিয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ে ইউনিট সংখ্যায় ২৩.৮১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রপ্তানির শক্তিশালী চাহিদার ইঙ্গিত দেয়। পাশাপাশি ইউনিট দামে ১.০৬ শতাংশ বৃদ্ধি দেশের রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতামূলক প্রান্ত বজায় রাখার সক্ষমতাও তুলে ধরে।

অন্যদিকে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

ভারতের রপ্তানি বেড়েছে ১৬.২৬ শতাংশ, পরিমানে বেড়েছে ১৫.৯২ শতাংশ এবং দামে সামান্য ০.২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের রপ্তানি বেড়েছে ১১.২১ শতাংশ, অন্যদিকে পরিমানে  ১৫.৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৯৫ শতাংশ। কম্বোডিয়া ২৪.২৮ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধি ও ৩১.১১ শতাংশ পরিমানে বৃদ্ধির মাধ্যমে চমক দেখিয়েছে, যদিও প্রতি ইউনিট দামে ৫.২১ শতাংশ পতন ঘটেছে।ভিয়েতনামের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৯৬ শতাংশ এবং ইউনিট সংখ্যায় ১৩.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি, ইউনিট দামে ৩.৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।

বাংলাদেশের উন্নতির পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে একক দেশের উপর নির্ভরতা কমানের যে উদ্যোগ টা একতা বড় ভুমিকা পালন করেছে। অন্নদিকে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও সরবরাহ চেইনে বৈচিত্র আনার চেষ্টার কারণে আমদানিকারকরা চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। তাছাড়া, বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে কম উৎপাদন খরচ ও দক্ষ শ্রমশক্তির কারণে বাংলাদেশ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে আকর্ষণীয়।

চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের পুরো বছর শেষে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরও দৃঢ় অবস্থান নিতে পারবে। তবে, এ ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক আলচনা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে করে আমেরিকার সাথে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক আর ভাল হয়।   

যদিও বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি তুলনামূলকভাবে অনেক কম, যা তৈরি পোশাক উৎপাদনের খরচও কমিয়ে আনে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য পায়। কিন্তু শুধু কম মজুরি দিয়ে আমরা ভাল করতে পারবনা এবং প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে পারবনা।  

যেহেতু বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশ এবং আমাদের দক্ষ শ্রমিক, অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা এবং আধুনিক কারখানা অবকাঠামো রয়েছে, যা দ্রুত ও বড় পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব করে তোলে। এটাকে কাজে লাগিয়ে বেসিক আইটেম নয়, দামি ডিজাইন ও ফ্যাশনেবল পণ্যও তৈরি করার প্রতি জোর দিতে হবে, যা মার্কিন বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে পণ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রে। একটি নির্ভরযোগ্য পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আমরা পরিচিত। সময়মতো পণ্য ডেলিভারি এবং গুণগত মান বজায় রাখা মার্কিন ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু আমাদের আত্মতুষ্টিতে নিমজ্জিত না হয়ে, সামনে এগিয়ে যাবার জন্য আর উন্নত সরবরাহ ব্যাবস্থা গরে তুলতে হবে।

চীনের শ্রম খরচ বৃদ্ধি, ভূরাজনৈতিক চাপ ও মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে অনেক মার্কিন ক্রেতা বিকল্প উৎস খুঁজছে। বাংলাদেশ সেই বিকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

চীনের বিনিয়োগ স্থানান্তর এবং মার্কিন ক্রেতাদের বাংলাদেশে পণ্য ক্রয়ের ঝোঁককে কাজে লাগাতে হলে, আমাদের এমন পণ্যের ওপর জোর দিতে হবে, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বর্তমানে চীন থেকে আমদানি করে থাকে। এই নির্দিষ্ট পণ্যগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারলে বাংলাদেশ একটি বিকল্প সরবরাহকারী দেশ হিসেবে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশকে এমন একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক ও বিনিয়োগকারীরা কোনও প্রকার জটিলতা বা বাধা ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করলে বিদেশি বিনিয়োগে আস্থা তৈরি হবে। এর পাশাপাশি, বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি খাতের উচিত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি খাদ্যশস্য ও তুলাআমদানি করা, কারণ এতে করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আসবে এবং বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে। এটি শুধু সম্পর্ক উন্নয়নেই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ যদি তৈরি পোশাক খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায়, তবে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য, এবং দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

এই বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে হলে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে হবেএবং আলোচনার ক্ষেত্রে কৌশলগত অগ্রগতিআনতে হবে। শুধু রপ্তানি বাড়ানো নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশকে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করাও জরুরি।

আমার কাছে সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী অংশটি হলো শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, বরং এর পেছনের মানবিক গল্পগুলো। প্রতিটি মিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো শ্রমিকের ঘাম, আছে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর সংগ্রাম, আছে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার এক অদম্য লড়াই।

বর্তমান তীব্র প্রতিযোগীতামূলক ব্যবসায় জগতে প্রতিযোগিতা ভয়ংকর। ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়া সবাই লড়ছে একই জায়গায় জায়গা দখলের জন্য। তবু বাংলাদেশ দেখাচ্ছে, প্রতিকূলতা ঠেলে দিয়েও কিভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়। এটা আমাদের জন্য শুধু গর্বের নয়, ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনাও বটে।

আমি বিশ্বাস করি, পোশাক খাতের এই অর্জন আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি আরও মজবুত করবে। তবে একই সঙ্গে আমাদের ভাবতে হবে, কিভাবে এই প্রবৃদ্ধিকে বহুমুখীকরণ করা যায় । প্রযুক্তি, বৈচিত্র আর টেকসই উৎপাদনের দিকে নজর দিয়ে। কারণ ভবিষ্যতের বৈশ্বিক বাজার শুধু সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করবে না; সেখানে টিকে থাকতে হবে গুণগত মান, দক্ষতা আর টেকসই উন্নয়নের মাপকাঠিতে।

তৈরি পোশাক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের এই অদম্য অগ্রযাত্রা একবারে হঠাৎ আসেনি। এটি এসেছে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং আত্মত্যাগের ফসল হিসেবে। তাই এই সাফল্যকে আমরা শুধু অর্থনীতির পরিসংখ্যান দিয়ে মাপব না; এটি হবে আমাদের গর্ব, আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পথচলার প্রেরণা।

লেখক: শাহীন হাওলাদার, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

এসআই

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *