যেদিন এভিন কারাগারে সময় থমকে গিয়েছিল

Google Alert – সামরিক

২৩ জুন, দুপুর ১২টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। তেহরানের আকাশ যেন হঠাৎ বিদীর্ণ হলো।

মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে এভিন কারাগারে আছড়ে পড়ল ইসরায়েলের ৯টি ক্ষেপণাস্ত্র। দুটি অবিস্ফোরিত থাকল— হয়তো প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল, নয়তো অন্য প্রাণের দাবি ছিল। কিন্তু বাকি সাতটি ক্ষেপণাস্ত্র নির্ভুলভাবে লক্ষ্য ভেদ করেছিল এমন স্থানে—যেখানে অস্ত্র নয়, কেবল ছিল নিরীহ মানুষ।

এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এমন ভবনে আঘাত করেছিল, যেখানে কোনো সামরিক ঘাঁটি বা ব্যারাক ছিল না; বরং সেখানে ছিল হলরুম, প্রশাসনিক দপ্তর, সৈন্যদের বিশ্রামকক্ষ ও বন্দিদের পরিবারের চলাচলের জায়গা।


মৃত্যুর ছায়ায় থেমে যায় সময়


এভিন কারাগারের চিকিৎসা শাখার দপ্তরের ঘড়িটা প্রায় ৪০ দিন ধরে একই সময়ে আটকে আছে: ১১:৫০ মিনিট। যে সময়টায় ক্ষেপণাস্ত্রের বিষাক্ত আগুন তার প্রাণঘাতী ছোবল বসায় দেওয়ালগুলোতে। ঘড়ির কাঁটা তখনই থেমে যায়— আর কোনোদিন চলেনি।



ধ্বংস হয়ে যাওয়া কয়েকটি গাড়ি


মিলনমেলার স্থান হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী


সম্প্রতি কিছু সাংবাদিক এভিন কারাগার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তারা দেখতে পান— সেই পরিচিত প্রবেশপথ আর নেই। নতুন গেট বসানো হলেও, পূর্বের দেয়াল-ইট কেবল ধ্বংসের স্মৃতি বহন করছে। ভবনের আশেপাশের গাড়িগুলো বিস্ফোরণের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কিছু গাড়ি এতটাই বিকৃত যে, বোঝাই যায় না কোনটা বনেট, কোনটা পেছনের সিট।


মায়া-ভরা সাক্ষাৎ, রূপ নেয় মৃত্যুতে


সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যের জন্ম হয় সাক্ষাৎ কক্ষে। যেখানে কেউ এসেছিলেন ছেলেমেয়ের জামিনে ছাড়া নিতে, কেউ স্বামীকে শেষবারের মতো দেখতে। সেই হল এখন একটি অর্ধসমাপ্ত ধ্বংসস্তূপ। ধুলো ও ভাঙা দেওয়ালের মাঝে পড়ে আছে ছোট্ট জুতো, অর্ধদগ্ধ বোরকা, ছেঁড়া জামার অংশ— যেগুলোর মালিকেরা আর বেঁচে নেই।


এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “সবাই পালানোর পথ খুঁজছিল। ভাবলাম আবার হামলা হতে পারে, তাই বিশ-পঁচিশজনকে নিয়ে দৌড়ে নিচতলায় চলে গেলাম। বিশ মিনিট পর উপরে উঠে দেখি—ভয়ঙ্কর দৃশ্য। যেন সারা পৃথিবী ভেঙে পড়েছে। এক ব্যক্তি এসেছিলেন তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে, হাতে ছিল ফুল। তখনো দেখা হয়নি তাদের। আর যখন উপরতলায় ফিরলাম, দেখি স্ত্রী আগেই শহীদ হয়েছেন, স্বামীটি তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন…”

 

এভিন কারাগার


অসম্পূর্ণ উদ্ধার, মায়ের বুকে সন্তানের মৃত্যু 


সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হলো দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করা ভবনের। এক সমাজকর্মী মা তার পাঁচ বছরের সন্তান নিয়ে ভবনে ছিলেন। প্রথম ক্ষেপণাস্ত্রে মা শাহাদাতবরণ করেন। এসময় এক ব্যক্তি শিশুটিকে কোলে নিয়ে বের হতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ঠিক তখনই দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। দুজনেই একে অপরের কোলে ধরে আঁধারের নিচে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। সেই ব্যক্তি নিজেও ছিলেন একজন পিতা, যার সন্তান ছিল সেই শিশুরই বয়সী…


বন্দিরা যখন উদ্ধারকর্মী


এই শোকের মাঝেও কিছু আলো জ্বলেছিল। কয়েকজন বন্দি পালাতে পারতেন, কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে আহতদের উদ্ধার করেন। কেউ কেউ আহতদের বের করে এনেছিলেন। এমনকি একজন আহত চিকিৎসক সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন: “বন্দিরাই আমাকে বাঁচিয়েছে… কোনো চিন্তাভাবনা না করেই, শুধু মানুষ হওয়ার কারণে। “


অজানা শহীদদের তালিকা


২৩ জুনের বর্বরোচিত হামলায় নিহতের সঠিক সংখ্যা এখনো নিশ্চিত নয়। প্রাথমিক হিসাবে শতাধিক। অনেক লাশই বিস্ফোরণের তীব্রতায় চেনা যায়নি, ডিএনএ টেস্টে শনাক্ত করা হয়েছে। শহীদদের মধ্যে ছিলেন বন্দিদের পরিবারের সদস্য, সমাজকর্মী, প্রশাসনিক কর্মী, সৈন্য, সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া তরুণ ও কারাগারের আশপাশে বসবাসকারী মানুষেরা।


এর মধ্যে একজন ছিলেন হাজের মোহাম্মদি— একজন নারী যিনি এক বন্দির মুক্তির জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। সেই দিনই তিনি কাগজপত্র দিতে এভিনে এসেছিলেন। কোনো সম্পর্ক ছাড়াই, শুধু ভালো কাজের জন্য। তিনিও শহীদ হয়েছেন।


আরেক তরুণী, যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন, তিনি অনলাইনে অর্থ সংগ্রহ করে কারাগারে এসেছিলেন। তার মৃত্যুর পর জানা গেল, তিনি ইতোমধ্যেই তার বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন। সেই দিন তিনি শুধু কয়েকজন বন্দির মুক্তির জন্যই এসেছিলেন।


ধ্বংসের মুখোমুখি জীবিতরা


এভিনের তিনতলা প্রশাসনিক ভবনও ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্য ছিল। সেই ভবনের একটি তলা ছিল মূলত নারী কর্মীদের কর্মস্থল—সেটিও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। দ্বিতীয় তলার সৈন্যদের বিশ্রামকক্ষ মাটির সাথে মিশে গেছে। নিচের তলার প্রশাসনিক অফিসও ধ্বংসস্তূপ, এখনো সেখানে প্রবেশ ঝুঁকিপূর্ণ।


একটি নিষ্ক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র সেখানেই পড়েছিল— যেন শুধু ভয় দেখাতে বা পালানোর পথ খুলে দিতে। কিন্তু সেই দিন কেউ পালায়নি।

এভিন কারাগারের সময় থমকে গেছে, কিন্তু গল্প চলছে…


এমজেএফ

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *