যে হামলায় ইসরায়েলের ‘প্রযুক্তির মেরুদণ্ড’ ভেঙে দিল ইরান

Google Alert – সামরিক



ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ব্রিফ করছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট আলোন চেন। ছবি: এএফপি

“>



ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ব্রিফ করছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট আলোন চেন। ছবি: এএফপি

ইরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তেল আবিবের দক্ষিণে রিহবেত শহরে ইসরায়েলের বিখ্যাত সামরিক-সংশ্লিষ্ট গবেষণাগার ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ‘পুরোপুরি ধ্বংস’ হয়ে গেছে।

ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভির এক প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ও সামরিক গবেষণার মূল ভিত্তি হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি এখন কার্যত অচল ও বিধ্বস্ত।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুসারে—ইরানের সুনির্দিষ্ট এই হামলাকে ‘ভুল করে আক্রমণ’ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। বরং এর লক্ষ্য ছিল পদার্থবিদ্যা, বায়োটেকনোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ সামরিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ এই কেন্দ্রটিকে গুড়িয়ে দেওয়া।

ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল ১৩–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট আলোন চেন স্বীকার করেছেন যে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকাণ্ড কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোয় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে আঘাত করায় এর ব্যাপক ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এবং আমাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন ৩০০ মিলিয়ন ডলার থেকে অর্ধ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়।’

এ বিষয়ে চেনের ব্যাখ্যা—কমপ্লেক্সটির দুটি অংশ ছিল: একটি ছোট আবাসিক ও অন্যটি বৃহৎ বৈজ্ঞানিক অংশ। এর মধ্যে ইরান তুলনামূলকভাবে বড় অংশটিতে আঘাত করেছে। অর্থাৎ তারা ইনস্টিটিউটের হৃৎপিণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করেছে এবং তাদের হামলা ছিল অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট।

ক্ষয়ক্ষতির ছবি প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘ইরান যাতে এসব স্থাপনায় আবারও আঘাত করতে না পারে সেজন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

তার ভাষ্য, ‘এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ইরানিরা ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। শুধু ভাইসমান ইনস্টিটিউটই নয়, অনেক সামরিক ঘাঁটি ও কৌশলগত স্থান, যেগুলো এখনো আমরা প্রকাশ্যে আনিনি।’

চ্যানেল-১৩ বলছে—পরিস্থিতি এমন যে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ইরানের সুনির্দিষ্ট হামলা, ব্যাপ্তি ও অনেক জায়গার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখনো অবগত নন।

বিধিনিষেধ সত্ত্বেও যেসব ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠেছে।

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: রয়টার্স

“>

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: রয়টার্স

কয়েক দশকের গবেষণার ক্ষতি

গত ১৫ জুন ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলে তৈরি করা ভাইসমান ইনস্টিটিউটের বড় ধরনের ক্ষতি হয়। কমপ্লেক্সটির একাধিক অংশকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

একটি নবনির্মিত রাসায়নিক ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এটি এ বছরই চালু হওয়ার কথা ছিল।
জীবন ও গণনামূলক বিজ্ঞানচর্চার জন্য নিবেদিত ভবনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত একটি ল্যাবে আগুন লেগেছে। এই স্থাপনাটিতে ক্যানসার ও কোষ পুনরুৎপাদনের ওষুধসহ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্প চলছিল।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘কার্ডিয়াক রিজেনারেশন’ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এলদাদ জাহরের। তার ২২ বছরের গবেষণার ফসল—হৃৎপিণ্ডের হাজারো টিস্যু, ডিএনএ ও আরএনএ, অ্যান্টিবডি ও ল্যাবে তৈরি ভাইরাসের নমুনাসহ সবই ধ্বংস হয়ে গেছে।

তিনি তার গবেষণাগার ধ্বংসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘গত ২২ বছর ধরে ল্যাবটি আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছিল। দেখলাম যে ১৫ মিনিটের মধ্যেই আগুন সেটিকে কীভাবে গ্রাস করছে। ভবনের তিনটি তলা পুরোপুরি ধসে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই… কোনো তথ্য নেই, ছবি নেই, নোট নেই, কোনো ইতিহাস নেই।’

ইনস্টিটিউটজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৪৫টি ল্যাব ধ্বংস হয়েছে এবং এতে প্রায় ৪০০–৫০০ গবেষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ল্যাবগুলোর মধ্যে জীবনবিজ্ঞান, অণুজীববিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞানের ল্যাবও ছিল, যেখানে অপরিবর্তনীয় টিস্যু স্লাইড ও সেল লাইন নষ্ট হয়েছে।

প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস ভবন—যেখানে ভূ-রসায়ন ও অন্যান্য গবেষণা চলত, সরাসরি আঘাতে নয় বরং পার্শ্ববর্তী রসায়ন ভবনে আঘাত করা ক্ষেপণাস্ত্রের শকওয়েভে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

প্রেস টিভি বলছে—ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইনস্টিটিউটের প্রায় ৯০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ৩০০–৫৭০ মিলিয়ন ডলার।

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: রয়টার্স

“>

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: রয়টার্স

সামরিক-সংশ্লিষ্টতা

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সকে ‘বেসামরিক’ বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং এখানকার অনেক গবেষণা প্রতিবেদন একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। তবে এর অনেক প্রকল্প সামরিক গবেষণার সঙ্গে জড়িত, যা কখনোই প্রকাশ্যে আনা হয় না।

ইসরায়েলি ও পশ্চিমা মিডিয়া প্রায়শই এই ইনস্টিটিউটের মৌলিক ও প্রায়োগিক বিজ্ঞানের অর্জনগুলোকে তুলে ধরে, সামরিক-সংশ্লিষ্টতাকে হালকা করে দেখায়।

তবে ভাইসমান ইনস্টিটিউট ‘এলবিত সিস্টেমস’র মতো সামরিক ঠিকাদারদের সঙ্গে যৌথভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি, দ্বৈত-ব্যবহার্য সামগ্রী উদ্ভাবন ও পারমাণবিক গবেষণার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে স্পষ্ট ও নথিভুক্ত সংযোগ বজায় রেখে চলে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে এই ইনস্টিটিউট এলবিত সিস্টেমসের সঙ্গে চুক্তির ঘোষণা দেয়, যেখানে ‘সামরিক প্রয়োগের জন্য জীব-অনুপ্রাণিত উদ্ভাবনী উপাদান’ তৈরির কথা বলা হয়। এটি স্পষ্টত সামরিক প্রযুক্তির উন্নয়নের ধারণা দেয়।

এ ছাড়াও, ভাইসমান ইনস্টিটিউট ‘এলবিত সিস্টেমস’র সঙ্গে ইসরায়েলি আল্ট্রাভায়োলেট ট্রান্সিয়েন্ট অ্যাস্ট্রোনমি স্যাটেলাইট (আল্ট্রাসেট) প্রোগ্রামে অংশ নেয়। এর উদ্দেশ্য একদিকে ছিল বৈজ্ঞানিক, অন্যদিকে দ্বৈত-ব্যবহার।

কাছেই কিয়াত ভাইসমান সায়েন্স পার্কে উল্লেখযোগ্য ইসরায়েলি অস্ত্র তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান—রাফাল, ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই) ও এলবিত সিস্টেমসের অফিস আছে। এটি গবেষণা-উন্নয়ন পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে ইনস্টিটিউটের কাজ পরোক্ষভাবে প্রতিরক্ষা খাতকে সহায়তা করে।

এই ইনস্টিটিউটের অনেক গবেষণা প্রকল্প যখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুদান পায় তখন সেটি সামরিক-শিল্প জোটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।

ইনস্টিটিউটটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি, সাইবার সিকিউরিটি, ভৌত বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, স্বায়ত্তশাসিত সিস্টেম, ইলেকট্রনিক ট্র‌্যাকিং ও জ্যামিং এবং বিকল্প জিপিএস নেভিগেশনসহ ইসরায়েলি সামরিক সক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এসব প্রযুক্তি বিমান হামলা সমন্বয়, যুদ্ধক্ষেত্রের চিকিৎসা অগ্রগতি ও সাইবার প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হয়।

ইনস্টিটিউটের স্নাতকরা প্রায়শই অভিজাত সামরিক শাখা ‘ইউনিট ৮২০০’ ও ‘তালপিয়ট প্রোগ্রাম’-এ যোগ দেন। তারা ইসরায়েলের শীর্ষ সিগন্যাল ও সাইবার যুদ্ধ বিভাগ এবং বৈজ্ঞানিক ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দেয়।

অধ্যাপক ইরান সেগালের ল্যাবের মতো আরও কয়েকটি ল্যাবকে গাজা ও ইরানসহ ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাৎক্ষণিক নজরদারির জন্য অ্যালগরিদমিক সিস্টেম উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

অনেক গবেষক ড্রোনের সুরক্ষা নিয়েও কাজ করছেন। এটি সরাসরি সামরিক প্রযুক্তিতে অবদান রাখছে।



ধ্বংস হয়ে যাওয়া ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছেন ইসরায়েলি অধ্যাপক রোয়ি ওজেরি। ছবি: রয়টার্স

“>



ধ্বংস হয়ে যাওয়া ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছেন ইসরায়েলি অধ্যাপক রোয়ি ওজেরি। ছবি: রয়টার্স

১৯৪৮ সালে নাকবা’র সময় ভাইসমান ইনস্টিটিউটের যন্ত্রপাতি ও ক্যাম্পাস সরঞ্জামাদি সরাসরি জায়নিস্ট প্যারামিলিটারি দল হাগানাহ’র কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে নতুনভাবে গঠিত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাজেও তা ব্যবহৃত হয়।

ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও প্লাস্টিক বিস্ফোরক, রকেট, মর্টার ও কামান শেল, ন্যাপালম, টিয়ার গ্যাস ও মাইনসহ নানা ধরনের সমরাস্ত্র তৈরিতে যুক্ত।

নাকবা’র শেষের দিকে এই ইনস্টিটিউট সামরিক বিজ্ঞান দলের মূল ভিত্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং টেকনিয়নকে সঙ্গে নিয়ে ইসরায়েলি শাসন ব্যবস্থার প্রধান সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

উভয় প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ প্রশাসক ও শিক্ষকরা ইসরায়েলের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা ইসরায়েলি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সামরিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ধারণাকে সমর্থন করেন, দেশীয় উন্নয়ন ও উন্নত অস্ত্র তৈরির জন্য চাপ দেন।

এর ফলে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ইসরায়েলি সামরিক নেতৃত্বের প্রায়শই বিরোধ হতো। কেননা, সামরিক নেতারা সামরিক গবেষণা ও উন্নয়নের প্রতি আরও রক্ষণশীল ও বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদেরই জয় হয়। তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব প্রতিষ্ঠা পায়। সামরিক বিজ্ঞান বিভাগ সামরিক কমান্ড থেকে আলাদা হয়ে গবেষণা ও ডিজাইন দপ্তরের রূপ নেয়। এতে নেতৃত্ব দেন ভাইসমান ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রশাসক আর্নস্ট ডেভিড বার্গম্যান।

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: রয়টার্স

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: রয়টার্স

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *