রক্তের মানচিত্রে আদিবাসীদের সাহসের ইতিহাস

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধে কাধ মিলিয়েই যুদ্ধ করেছেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন তারা। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র বা ইতিহাসে তাদের অবদানের কথা কতটুকু উঠে এসেছে— তা জানাতেই তৃণমূলের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কিছুটা তুলে ধরছি।

কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রংয়ের সঙ্গে। তার বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার রাংরাপাড়া গ্রামে। একাত্তরে তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বললেন যেভাবে, “মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। পরিবারসহ আমরা চলে যাই ভারতে, বাগমারা শরণার্থী ক্যাম্পে। ওখানে খাবারের কষ্ট ছিল খুব। তবুও কষ্ট করে থেকেছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? দেশকে তো মুক্ত করতে হবে। বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধে যাওয়ার।

ট্রেনিংয়ের জন্য নাম লেখাই প্রথমে বাগমারা ইয়ুথ ক্যাম্পে। দশদিনের লেফট-রাইট চলে সেখানে। অতঃপর আমাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় তুরার রংনাবাগ ট্রেনিং ক্যাম্পে। ২১ দিনের ট্রেনিং হয় সেখানে। সাত নম্বর কোম্পানিতে আদিবাসী ছিলাম ৯১ জন, ১০ জন গারো আর হাজং ১ জন। বাকিদের প্রায় সবাই উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল, ওঁরাওসহ বিভিন্ন জাতির মানুষ।

ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় দুর্গাপুরের দক্ষিণে, বাদামবাড়ির রাঙাছড়ায়। এগার নম্বর সেক্টরের তখন কমান্ডার ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ। আর এক নম্বর কোম্পানি কামান্ডার ফজলুল রহমান আকঞ্জী। আমাকে এক নম্বর প্লাটুনের সেকশন কমান্ডার করা হয়। কোনো কোনো সময় প্লাটুন বা কোম্পানি কমান্ডার না থাকলে আমাকেই কোম্পানি বা প্লাটুনের দায়িত্ব পালন করতে হতো। রক্তক্ষয়ী অপারেশ করেছি দুর্গাপুরের সিও ডেভলপমেন্ট অফিস, গোপালপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় আদিবাসী-বাঙালিতে ছিল না কোনো ভেদাভেদ। সবার ওপরে ছিল দেশ। বাঙালি সহযোদ্ধা বন্ধু কাঞ্চন ও লাল মিয়ার কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন ভদ্র। তার ভাষায়, “আমরা ভাইয়ের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। একে অপরের পাশে থেকেছি। যুদ্ধের সময় একজন আরেকজনের প্রাণও বাঁচিয়েছি। তখন তো কোনো জাত-পাত ছিল না।”

আদিবাসীদের ত্যাগের ইতিহাসও তুলে ধরেন এই মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম দেড় থেকে দুই হাজার গারো আদিবাসী। হালুয়াঘাটে শহীদ হয় আড়ং রিসিল ও পরিমল দ্রংসহ তিনজন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গরম পানিতে ঝলসে দেয় তাদের শরীর। গাড়ির পেছনে তাদের শরীর বেধে দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল ওরা। এভাবে স্বাধীনতার জন্য আদিবাসীরাও যুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর কেবল বাঙালিত্বই এখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আদিবাসীরা কী পেয়েছে?”

একাত্তর প্রসঙ্গে কথা হয় আরেক মুক্তিযোদ্ধা খ্রীষ্টফার মুর্মূর সঙ্গে। এ সাঁওতাল আদিবাসীর বাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার সাকইরডাঙ্গা গ্রাম। একাত্তরে ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। একাত্তরে তিনি এক মাসের ট্রেনিং নেন ভারতের পতিরাম ক্যাম্প থেকে। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধ করেন সাত নম্বর সেক্টরে। তাদের ১২ জনের দলের কমান্ড করতেন ইয়াকুব ও আনোয়ার।

দিনাজপুর মুক্ত হওয়ার দিনটির কথা এখনও তার মনে পড়ে। তিনি বললেন যেভাবে, “হামজাপুর ক্যাম্প থেকে সুন্দরায় বর্ডার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। উদ্দেশ্য দিনাজপুর শহর দখলে নেওয়া। বিভিন্ন দলে ৬০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা আমরা। পেছনে সহায়তায় ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। রাতে এসেই পজিশন নিই দিনাজপুর সদরের স্কুলপাড়ায় খালের পাড়ে।

খালের একপাশে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। ভোর হতেই শুরু হয় গোলাগুলি। চলে বিকেল পর্যন্ত। বড় যুদ্ধ ছিল ওটা। মাথার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ করে গুলি চলে। একটু উনিশ-বিশ হলেই মারা পড়তে হতো। সন্ধ্যার আগেই দখলে নিই ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত। সেখান থেকে আমাদের দলটি নদীর পশ্চিম অংশ দিয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে। বিরল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দলও এগিয়ে আসে। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোরবেলা। কুঠিবাড়ি দিয়ে ষষ্ঠীতলা হয়ে আমরা দিনাজপুরের মর্ডান মোড়ে এসে পজিশন নিই। খুব আনন্দ হয়েছিল ওই দিনটিতে।”

মুক্তিযোদ্ধা খ্রীষ্টফার মুর্মূ

বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন খ্রীস্টফার মুর্মূ। মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্বাধীনতা এনেছেন এই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু স্বাধীন দেশে নিজের দুই একর ২৬ শতক জমি আজও স্থানীয় বাঙালিদের দখলে। আদালতের রায় পেলেও বুঝে পাচ্ছেন না ওই জমি। আক্ষেপ নিয়ে তিনি শুধু বললেন, “আমার দেশের মাটি আমাকেই রক্ষা করতে হবে। তাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। স্বাধীন দেশ পেলাম। কিন্তু স্বাধীন দেশে নিজেই আজ পরবাসী। এই দুঃখ কাকে বলব, দাদা।”

দিনাজপুরের হালজায় রয়েছে কড়া নামের নিশ্চিহ্নপ্রায় একটি আদিবাসী জাতি। এ জাতির মাত্র বিশের অধিক পরিবার এখনও টিকে আছে ঝিনাইকুড়ি গ্রামে। কড়া গ্রামের সাতান কড়া ও থোপাল কড়াও একাত্তরে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ শুরু হলে আশাপাশের আদিবাসী পাড়ার যুবকদের সাতান বলতে থাকেন, “চালা দেশ স্বাধীন কারোওয়ে, সবইন মিলকে দেশ স্বাধীন করোওয়ে” (চল দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে যাই, সবাই মিলে দেশ স্বাধীন করি)।

তারা প্রথমে শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পে এবং পরবর্তীতে উচ্চতর ট্রেনিং নেন শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। এরপর চলে আসেন বড়গ্রাম ক্যাম্পে। সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন হিলির নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে। সাতান কড়া ও থোপাল কড়া এখন প্রয়াত। জীবদ্দোশায় কথা হয়েছিল তাদের সঙ্গে। নিভৃতে থাকা ত্যাগী ও অভিমানী এ দুই মুক্তিযোদ্ধা কোনো কাগুজে সনদপত্র নেননি। ফলে মৃত্যুর পরও মেলেনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান।

মুক্তিযোদ্ধা সাতান কড়া

মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদানের প্রসঙ্গটি উঠলেই প্রশ্ন ওঠে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাটি নিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরও ওই সংখ্যাটি সরকারিভাবে প্রণয়ন করা হয়নি। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন জাতির বীরত্বের ইতিহাসটিও লিপিবদ্ধ করা হয়নি আলাদাভাবে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত একটি জনযুদ্ধ। একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস। ওই ইতিহাসে আদিবাসীদের ত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনি তুলে ধরতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসও পূর্ণাঙ্গতা পাবে না।

এবার তাকাই একাত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অংশগ্রহণের দিকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা রাজপরিবারের সদস্য কে কে রায়। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র লারমার ভূমিকাও ছিল ইতিবাচক। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে রাঙামাটি জেলা সদরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। যার নেতৃত্ব দেন রাঙামাটি সরকারি কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান এবং সুনীল কান্তি দে।

এছাড়া এক নম্বর সেক্টরের অধীনে সর্বপ্রথম পঁচিশ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। ওই দল গঠনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। যে দলটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কোম্পানিটির কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয় হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরাকেই। আর এ কারণে পাকিস্তানি সেনারা পাহাড়ে আদিবাসী মা-বোনদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায় এবং অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করে। কেননা তারা ভেবেছিল যেহেতু চীন তাদের সমর্থনে সেহেতু বৌদ্ধ আদিবাসীরাও পাকিস্তানিদের পক্ষে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

একাত্তরের উত্তাল দিনে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা থেকে বাঁচতে শত শত মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগেই তারা আশ্রয় পেয়েছিল মানিকছড়ির মং রাজা (মারমা রাজা) মং সেইনের রাজবাড়িতে। পরবর্তীতে তিনিও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধকালে মানিকছড়ি রাজবাড়িতে আশ্রয় শিবির এবং ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, মুজিবনগর সরকারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের কয়েকটি গাড়ি এবং ত্রিশটিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রদান করেন এই আদিবাসী রাজা। অতঃপর তিনি ত্রিপুরার সাবরুম থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে আসেন রূপাইছড়ি শরণার্থী শিবিরে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের কাজে যুক্ত থাকেন। নিরাপত্তার খাতিরে ভারতীয় সরকার ওই সময় তাকে অনারারি কর্নেল উপাধি প্রদান করেছিল। এরপরই তিনি আখাউড়াসহ বেশ কয়েকটি অপারেশনের পুরোভাগে থেকে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।

এছাড়া অনেকেই জানি কাঁকন বিবির বীরত্বের কথা। খাসি জাতির এই বীর নারীর নাম ছিল কাকাত হেনইঞ্চিতা। ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ ও ইপিআরের সদস্য হিসেবে ছিল অনেক চাকমা, মারমা, ম্রো, গারো, খাসি, লুসাইসহ আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকেরা। তৎকালীন ইপিআর সদস্য রমণী রঞ্জন চাকমা, হেমরঞ্জন চাকমা, খগেন্দ্র চাকমা, অ্যামি মারমা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। উক্যচিং মারমা মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীরবিক্রম উপাধি’ লাভ করেন, তাকে অনেকেই সংক্ষেপে ইউকেচিং বীরবিক্রম বলে চিনেন। বিমলেন্দু দেওয়ান, বরেন ত্রিপুরা, কৃপাসুখ চাকমা, আনন্দ বাঁশি চাকমাসহ প্রায় ২০-২২ জন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী একাত্তরে ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

উত্তরবঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রধান ঘাঁটি রংপুর ক্যান্টনমেন্টে ছিল ২৩তম ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার। এ হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানি লে. আব্বাসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রংপুরসহ উত্তরবঙ্গে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয় একাত্তরের মার্চে। ফলে পাকিস্তানি সেনারা বর্বর আক্রমণ চালায় পার্শ্ববর্তী সাঁওতাল গ্রামগুলোতে। তাদের আক্রমণে সাঁওতালরাও পিঁছু হটেনি। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ বাঙালির সঙ্গে তারাও দা-কুড়াল, তীর-ধনুকের মতো দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে। আদিবাসীদের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে সেনাদের অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। ফলে শত শত আদিবাসী ও বাঙালিদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয় ঘাঘট নদীর জল। এরপরই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল। আর অনেকেই অংশ নেয় মুক্তিযুদ্ধে।

সাঁওতালদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রেরণা জোগান সাঁওতাল নেতা সাগরাম মাঝি। এছাড়া গোদাগাড়ী রাজশাহীর বিশ্বনাথ টুডু একাত্তরে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় সাঁওতাল খ্রিস্টান যাজক ফাদার লুকাশ মারান্ডিকে, রাজশাহীর কাশিঘুটুতে ১১ জনকে ও রংপুর শহরের উপকণ্ঠে ২০০ জন সাঁওতালকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নির্মম শারীরিক নির্যাতন করা হয় গোদাগাড়ীর আদাড়পাড়া গ্রামের মালতী টুডুসহ বেশ কয়েকজন নারীকে। কিন্তু পরবর্তীতেও তারা পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

মুক্তিযোদ্ধার তালিকাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানাতেই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬২ জন। এছাড়াও দিনাজপুর জেলার ওঁরাও ও সাঁওতালদের প্রায় এক হাজার জনের সমন্বয়ে একটি বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা এলাকার গারো, হাজং, কোচ আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো থেকে প্রায় পনেরশ আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মধুপুর ভাওয়ালগড়ের চিন সাংমা, অশোক চিরানসহ ১২টি তাজা প্রাণ লড়ে মুক্ত করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলাকে। সুসং দুর্গাপুরে তাদের সংখ্যা আরও বেশি। সেখানে কমান্ডার ছিলেন গারো আদিবাসী সুজয় রেমা।

স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল মণিপুরি আদিবাসীরাও। এদের অন্যতম সৈনিক ছিলেন সাধন সিংহ, অনিতা সিনহা, বাণী সিনহা প্রমুখ। এছাড়া নীলমণি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ১ হাজার ২০০ মুক্তিসেনার এক প্রতিরোধ বাহিনী। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীদের মধ্যেই কমপক্ষে ৫০ জনের বেশি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নেয় এবং অনেকে জীবন উৎসর্গ করেন। তাদের মধ্যে গিরিশ সিংহ ও ভুবন সিংহ উল্লেখযোগ্য।

১২ অগাস্ট ১৯৭১। মৌলভীবাজারের ভানুবিলের মনিপুরি বিষ্ণুপ্রিয় ব্রাহ্মণ সার্বভৌম শর্মাকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। নিহত হন মাধবপুর গ্রামের গিরীন্দ্র সিংহ। এভাবে মৌলভীবাজার, কুলাউড়া, বড়লেখা, চুনারঘাট, মাধবপুর, বৈকুণ্ঠপুর, গোয়াইনঘাট, হবিগঞ্জের কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ৮৩টি চা বাগান এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০২ জন শহীদ, ৮৩ জন নির্যাতিত, ৪৩ জন আহত এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয় অনেককে। এ সময় কয়েকজন পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধেও যোগ দেন।

শুধু গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়াই নয়, একাত্তরে শব্দশিল্প, চিত্রশিল্প, নৃত্যশিল্প প্রভৃতির মধ্য দিয়েও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন অনিতা সিংহ, সাধন সিংহ, বাণী সিনহা প্রমুখ। নন্দেশ্বর সিংহ, বিজয় সিংহ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক কয়েকশ মুক্তিসেনার বাহিনী গড়ে তুলতে অসীম ভূমিকা রেখেছিলেন। যা এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে।

এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরাও পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার শিকার যেমন হন তেমনি তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়াসহ নারীরা ধর্ষণ ও নির্যাতিত হয়েছিলেন। কিন্তু এসবের খুব সামান্যতম ঘটনাও ইতিহাসে স্থান পায়নি। যা আজও তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। তাদের প্রশ্ন, রক্তের মানচিত্রে আদিবাসীদের বীরত্ব ও সাহসের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কবে তুলে ধরা হবে?

ছবি: সালেক খোকন

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *