রক্ত আর মৃত্যু পেরিয়ে বিজয়ের উল্লাস

Google Alert – সশস্ত্র

৫ আগস্ট, ২০২৪। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য দিন। এটি ছিল না কেবল একটি তারিখ, বরং বছরের পর বছর জমে থাকা ক্ষোভ, বেদনা, রক্ত আর সংগ্রামের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ। প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মুহূর্ত যেন বহন করছিল অগণিত মানুষের স্বপ্ন আর আত্মত্যাগের গল্প।

চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট, হাসপাতালের করিডোর, আর জনসমুদ্রের ভিড়ে মিশে ছিল হাহাকার ও উল্লাসের মিশ্র সুর—সকাল যেখানে শুরু হয়েছিল মৃত্যুর কান্নায়, দুপুর গড়িয়ে সেখানে জন্ম নেয় মুক্তির উল্লাসে।

২৯ জুলাই, দুপুরের পর থেকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে জড়ো হতে থাকে ছাত্র-জনতা। প্রতিবাদ চলছিল শান্তিপূর্ণভাবেই, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ভিন্ন রূপ নেয়। পুলিশের পাশাপাশি সরকারের সমর্থক বাহিনী চড়াও হয় বিক্ষোভকারীদের ওপর। ছত্রভঙ্গ হয় জনতা, কিন্তু থেমে যায় না ছাত্ররা—তারা ছুটে যায় চেরাগী মোড়ে, গড়ে তোলে নতুন প্রতিরোধ।

সড়কে চলছিল স্লোগান আর প্রতিবাদের ঢেউ। এক পাশে পুলিশের রাইফেল তাক করা, অন্যপাশে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা প্রিজন ভ্যানে তুলে নিচ্ছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। সেই দৃশ্য ছিল যেন কোনো যুদ্ধের বাস্তব চিত্র। নারী শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে প্রতিবাদমুখর স্লোগান আরও উজ্জীবিত করে আন্দোলনকারীদের। পুলিশ তখন ছুড়ল পর পর সাউন্ড গ্রেনেড—বিস্ফোরণে চারপাশ কেঁপে উঠলো, আতঙ্ক আর হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো। আমার পাশেই পড়েছিল দুটি গ্রেনেড। মনে হয়েছিল, হয়তো এখনই বুলেট বিদ্ধ হবো। সেই ভয়াল মুহূর্তে আত্মার ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিলাম।

৪ আগস্ট, চট্টগ্রাম রূপ নেয় আরও ভয়াবহ রণক্ষেত্রে। নিউমার্কেট, ওয়াসা, কাজীর দেউড়ি, লালখান বাজার—প্রতিটি মোড় যেন রণাঙ্গন। সশস্ত্র অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা রাস্তায় নেমে আসে। সেনা মোতায়েন হয়, সংঘর্ষ বাড়ে। শত শত শিক্ষার্থী আহত হয় পুলিশের গুলিতে, লাঠিপেটায়, আর সশস্ত্র হামলায়।

এই ভয়াবহতার মধ্য দিয়েই এগিয়ে আসে ৫ আগস্ট। নিউজ কাভারের জন্য সকালেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাই, আগের দিনের সংঘর্ষে আহতদের খবর নিতে। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড যেন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো—রক্তাক্ত মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কারো শরীরে গুলির চিহ্ন, কেউবা নিথর হয়ে পড়ে আছেন বেডে। আইসিইউতে কয়েকজন তরুণ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়ছেন। করিডোরজুড়ে স্বজনদের কান্না আর হাহাকার, হাসপাতালের পরিবেশ যেন এক যুদ্ধশেষ ধ্বংসস্তূপ।

কিন্তু দুপুরের পর বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। হঠাৎ খবর আসে, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সেই খবরে মুহূর্তেই পাল্টে যায় জনসাধারণের মনোভঙ্গি। কেউ আর ঘরে থাকতে চান না। রাস্তায় নেমে আসেন নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী, বৃদ্ধ, শিশুরা—সব বয়সী, সব পেশার মানুষ। আনন্দ আর বিজয়ের উল্লাসে ভরে যায় চট্টগ্রামের প্রতিটি রাস্তাঘাট। শহরের চেহারাই যেন বদলে যায় এক লহমায়। মনে হচ্ছিল, পুরো দেশ উদ্‌যাপন করছে একটি বহু কাঙ্ক্ষিত মুক্তির মুহূর্ত।

যে সকাল শুরু হয়েছিল হতাহতদের আহাজারির মধ্যে, আর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যায় এসে তা রূপ নেয় বিজয়ের উদযাপনে। ৫ আগস্ট তাই কেবল একটি তারিখ নয়—এটি ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণ, যখন দীর্ঘ শোষণ, নিপীড়ন আর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ চূড়ান্ত বিজয়ে রূপ নেয়।

লেখক— সাংবাদিক

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *