রাউজানে খুনখারাবির নেপথ্যে মাটি, বালুমহাল দখল ও চাঁদাবাজি 

Samakal | Rss Feed


রাউজানে খুনখারাবির নেপথ্যে মাটি, বালুমহাল দখল ও চাঁদাবাজি 

সারাদেশ

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম ও  প্রদীপ শীল, রাউজান 

<time class="op-modified" dateTime="2025-07-31"2025-07-31
2025-07-31

রাজনৈতিক আধিপত্য, মাটির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, বালুমহাল দখল ও চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গত ১১ মাসে চট্টগ্রামের রাউজানে খুন হয়েছেন ১৫ জন। এ সময়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে অর্ধশত। অপহরণ করা হয় অন্তত ১২ জনকে। এসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় না আসায় আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম উত্তরের এ উপজেলা। অভিযোগ রয়েছে, রাউজানে এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতার আধিপত্যের দ্বন্দ্ব।

দু’গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনার জেরে গত মঙ্গলবার রাতে বিলুপ্ত করা হয় গোলাম আকবর খোন্দকারের নেতৃত্বাধীন উত্তর জেলা বিএনপির পুরো কমিটি। একই দিন আরেক বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরীর দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ স্থগিত করা হয়। এদিকে একের পর এক খুন ও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন রাউজানের বাসিন্দারা। তাদের শান্তি দিতে দক্ষিণ রাউজানে নতুন থানা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। 

গতকাল বুধবারও খোন্দকার ও গিয়াস অনুসারীরা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে পালন করেছে নানা কর্মসূচি। রাউজানে খোন্দকারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে গিয়াসের অনুসারীরা। অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরে সংবাদ সম্মেলন করে গিয়াসকে চাঁদাবাজদের হোতা আখ্যায়িত করেছে খোন্দকার অনুসারীরা। 

১৪ ইউনিয়ন নিয়ে রাউজান গঠিত হলেও আট ইউনিয়নেই ঘুরেফিরে ঘটছে নানা অপরাধ। গোলাম আকবর খোন্দকার ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী– দু’জনেরই এসব ইউনিয়নে আলাদা বলয় রয়েছে। ইটভাটা বেশি থাকায় এসব ইউনিয়নে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার সুযোগও আছে অবারিত। 

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক ও এমপি পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ‘গিয়াস কাদের সমর্থিত নেতাকর্মীরা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির হাট বসিয়েছে রাউজানে। গত ১৭ বছর এলাকায় ছিল না তারা। অথচ ইটের ভাটা, ফসলি জমির মাটি ও নদীর বালু তুলতে এলাকায় রামরাজত্ব চালাচ্ছে তারা। রাউজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে রয়েছে গিয়াসের অনুসারী সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা। এই কাজে আমি বাধা হিসেবে থাকায় মঙ্গলবার আমাকে প্রাণে মেরে ফেলতে গুলিও চালিয়েছে তারা।’ এর আগেও সংবাদ সম্মেলন করে একই দাবি করেছিলেন গোলাম আকবর খোন্দকার। 

তবে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এর আগে সমকালকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক কারণেও খুন হচ্ছে রাউজানে। একক আধিপত্য ধরে রাখতে এতে ইন্ধন দিচ্ছেন গোলাম আকবর খোন্দকার। সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা খোন্দকারের অনুসারী।

খোন্দকার অনুসারীদের সংবাদ সম্মেলন
গিয়াস কাদের চৌধুরীর অনুসারী যুবদল নেতা আজিজুল হক ও সাবের সুলতান কাজলের নেতৃত্বে গোলাম আকবর খোন্দকারের ওপর পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে নগরীর দোস্ত বিল্ডিংয়ে রাউজান উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করা হয়। 

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আজিজুল হক ও সাবের সুলতান কাজলের নেতৃত্বে হামলায় অংশ নেন গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারী মোহাম্মদ রিয়াজ, শাহজান সাহিল, লিটন মহাজন, শাহাদত মির্জা, ইউসুফ তালুকদার, মোহাম্মদ সোহেল, মোহাম্মদ একরাম, রাসেল খান, মোহাম্মদ শহিদসহ ৭০ থেকে ৮০ জন।  অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালালে খোন্দকারসহ ৩০ নেতাকর্মী আহত হন। 

খোন্দকারকে অবাঞ্ছিত করল গিয়াস অনুসারীরা
রাউজানে গোলাম আকবর খোন্দকারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী সমর্থিত নেতাকর্মীরা। গতকাল রাউজানে মিছিল ও সমাবেশ করে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা এ ঘোষণা দেন। উত্তর জেলা বিএনপি সদস্য আবু জাফর চৌধুরীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিলে রাউজান সদর মুন্সিরঘাটা থেকে শুরু হয়ে জলিলনগর বাসস্টেশন চত্বরে যায়। সেখানে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপি নেতা নুরুল হুদা, ফিরোজ আহম্মদ, সৈয়দ মঞ্জরুল হক মঞ্জু, দিদারুল আলম, ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী টিপু, সাবের সুলতান কাজল, মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী সুমন প্রমুখ। 

থেমে নেই চাঁদাবাজি 
চাঁদা না দেওয়ায় মারধরের শিকার হয়েছিলেন প্রবাসী নুরুল আমীন। তিনি বলেন, ‘১৭ মার্চ দেশে আসার পর ২২ এপ্রিল রাউজানের বাড়িতে গেলে সেখানে আমাকে আটকে ২০ লাখ টাকা দাবি করে ছাত্রদল নেতা মুরাদসহ চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না দিলে আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। পরে ছেলে, ভাইসহ আমাকে পিটিয়েছে। আমার ভাই থানায় এজাহার দিয়েছে। প্রাণভয়ে আমি বিদেশ চলে এসেছি। যারা চাঁদাবাজি করছে, তারা রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে আছে।’ 

প্রাণভয়ে নুরুল আমীন বিদেশ পালালেও চাঁদা না দেওয়ায় আজম খান নামের আরেক প্রবাসীকে উরকিরচর ইউনিয়নে প্রাণ দিতে হয়েছে। চাঁদা না দেওয়ায় জীবন দিতে হয়েছে শুঁটকি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকেও। সর্বশেষ খুন হওয়া যুবদল নেতা মোহাম্মদ সেলিমের স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার বলেন, ‘শিশুকন্যা সাবরিনাকে মোটরসাইকেলে নিয়ে ওষুধ আনার পথে আমাদের সামনেই ৬ জুলাই খুন হন আমার স্বামী। বোরকা পরা সন্ত্রাসীরা কারা ছিল, তা এখনও বের করতে পারেনি পুলিশ। রায়হান ও ধামা ইলিয়াছ নামে দু’জনকে আমি শনাক্ত করলেও গ্রেপ্তার করা যায়নি তাদের।’ 

মাটির ব্যবসা নিয়ে তিন খুন 
রাউজানের পাঁচ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার একটি ওয়ার্ডে পাহাড়-টিলার মাটি অবৈধভাবে কেটে কৃষিজমি ভরাটে জড়িত একটি চক্র। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব কাজ করছে সন্ত্রাসীরা। স্থানীয়রা জানান, মাটি কাটার এ চক্রে বেশি সক্রিয় বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা। মাটি কাটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। খুন হয়েছেন তিন যুবদলকর্মী। হলদিয়া ইউনিয়নে মাটি কাটা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ১৫ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদলকর্মী কমর উদ্দিন জিতুকে। ১৯ এপ্রিল রাতে ভাত খাওয়ার সময় মুখে বন্দুক ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় বাগোয়ান ইউনিয়নের গরিবুল্লাহপাড়া এলাকার যুবদলকর্মী আবদুল্লাহ মানিককে। তিনি ইট, বালু ও মাটির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এলাকার আধিপত্য ও মাটি-বালুর ব্যবসা ঘিরে ২২ এপ্রিল যুবদলকর্মী মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে মাথা ও বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। 

বালুমহালের দখল নিতেও হাঙ্গামা 
রাউজানের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কর্ণফুলী ও হালদা নদী। স্থানীয় বাসিন্দা আবু সাঈম জানান, বালুমহাল ঘিরে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় আছে অন্তত ১৫ পয়েন্টে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হলদিয়া ইউনিয়নের সর্ত্তা খাল থেকে বালু তোলা হয় তিনটি পয়েন্টে। হলদিয়া, ডাবুয়া ও চিকদাইর পয়েন্টে বালু তোলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হালদা নদীর বালু ওঠানো হচ্ছে গহিরা, উরকিরচর ও মোবারকখীল পয়েন্ট দিয়ে। কর্ণফুলী নদীর বালু তুলতে দখলদারদের পছন্দ খেলার ঘাট, লম্বুর হাট, স্লুইসগেট ও বেতাগী এলাকা। পৌর এলাকা ও রাউজান সদর ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাউজান খাল, কাশখালী খাল ও পূর্ব গুজরা ইউনিয়নে থাকা ডোমখালী খালের বালুও তোলা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের ইচ্ছামতো। এটা ঘিরে যারা অপকর্ম করছে, তারা গিয়াস কাদেরের নাম ব্যবহার করছে। তবে গিয়াস কাদের তাঁর সম্পৃক্ত থাকার কথা সমকালের কাছে একাধিকবার অস্বীকার করেছেন। 

যেখানে আলাদা বলয়, সেখানেই পাল্টাপাল্টি হামলা 
রাউজানে ৫ আগস্টের পর বিএনপির উভয় গ্রুপের মধ্যে অর্ধশত হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১৯ জানুয়ারি উপজেলা বিএনপি ও পৌর কমিটি গঠন নিয়ে এ সংঘষের্র ঘটনা ঘটে। ৬ ডিসেম্বর বিজয় মেলা নিয়ে দুপক্ষের সংঘাতে ১১ জন আহত হয়। এ ছাড়া জলিলনগর, নোয়াপাড়া, বেরুলিয়া, কদলপুর ফকিরহাট এলাকায় একাধিক ঘটনায় ৫০ থেকে ৬০ জন আহত হয়। গত মঙ্গলবারও গিয়াস কাদের অনুসারীদের হামলায় খোন্দকার গ্রুপের অন্তত ২০ জন আহত হন। গত ১১ মাসের সব ঘটনা আমলে নিলে এমন আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে শতকের ঘরে। 

১২ জনকে অপহরণ  
গত সাড়ে পাঁচ মাসে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১২টি। এর মধ্যে গত ২৮ নভেম্বর নোয়াপাড়া থেকে খন্দকার গ্রুপের তিনজনকে অপহরণ করে প্রতিপক্ষ। ২৩ ডিসেম্বর পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের বড়ঠাকুরপাড়া থেকে অপহরণ করা হয় গিয়াসের এক অনুসারীকে। ২৮ ডিসেম্বর রাউজান পৌর যুবলীগের সহসভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে চট্টগ্রাম নগরী থেকে অপহরণ করা হয়। ১৮ জানুয়ারি রাউজান কুণ্ডেশ্বরী থেকে অপহরণ করা হয় যুবলীগ নেতা লক্ষ্মীকান্তকে। ২৯ ডিসেম্বর নুরুল ইসলাম নামে একজনকে অপহরণ করা হয় আঁধারমানিক এলাকা থেকে। 

যা বলছে প্রশাসন 
রাউজানের ইউএনও জিসান বিন মাজেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সহনশীল আচরণ করলে এলাকায় শান্তি থাকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে থাকে। অপরাধীরা সব সময় ছায়া খোঁজে। এসব দল বদল তাদের অপরাধ করার কৌশল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ জনগণকে শান্তি দিতে দক্ষিণ রাউজানে নতুন করে থানা স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানান তিনি। 

রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হত্যাকাণ্ড ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিটি হত্যা পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজের দলের কর্মীদের সামলাতে না পারলে পুলিশের পক্ষে একা অপরাধ দমন সম্ভব নয়। জড়িত অনেককেই আমরা গ্রেপ্তার করেছি। বাকিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। 

© Samakal

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *