Google Alert – সেনাবাহিনী
সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে থাকা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কৌশলগত শহর কিয়াকফিউ। বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী এ গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরের আকাশে প্রায় সবসময়ই ঘুরতে থাকে চীনা ড্রোন। কোথাও কোথাও স্নাইপারের গুলির আওয়াজও শোনা যায়। বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) অবস্থান মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। তবে এ পুরো পরিস্থিতিতে চীনের রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর কোনো দৃশ্যমান উপস্থিতি নেই। আছে একদল বেসরকারি চীনা মিলিশিয়া বাহিনী, যারা পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কিয়াকফিউতে ৫০ থেকে ১০০ অতিরিক্ত চীনা প্রাইভেট সিকিউরিটি সদস্যের আগমন ঘটে। তাদের দায়িত্ব বলা হয়েছিল ‘অবকাঠামোগত স্থাপনার নিরাপত্তা’। কিন্তু বাস্তবে তাদের ভূমিকা শুধু পাহারায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। অভিযোগ রয়েছে, তারা ড্রোন অপারেশন পরিচালনা করছেন, কখনো কখনো স্নাইপারও ব্যবহার করছেন বিদ্রোহী লক্ষ্যবস্তুতে। চীনা বিনিয়োগ সুরক্ষায় এটা কেবল পাহারা নয়, বরং এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক সামরিক অংশগ্রহণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি এক গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর। নিরাপত্তা রক্ষার নিছক ভূমিকাকে ছাড়িয়ে সরাসরি সংঘাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ। মিয়ানমারে এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথমবার, যেখানে চীনা বেসরকারি বাহিনী অবকাঠামোর সীমারেখা অতিক্রম করে সরাসরি সংঘাতের ময়দানে প্রবেশ করেছে।
মিয়ানমারের মতো সংঘাতবিধ্বস্ত দেশে চীনের এ নতুন ধরনের ভূমিকাকে অনেকেই বলছেন ‘কৌশলগত নীরব হস্তক্ষেপ’। কিয়াকফিউ অঞ্চল দিয়ে ভারত মহাসাগর থেকে সরাসরি জ্বালানি পৌঁছায় চীনে। মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে চীন যে পাইপলাইন নির্মাণ করেছে, তা এখন জীবন-মরণের লড়াইয়ের ময়দান হয়ে উঠেছে। ফলে কিয়াকফিউ ও মেইদ দ্বীপে চীনের ব্যস্ততা আর নিছক ব্যবসা নয়, এটা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব অবকাঠামো রক্ষায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ এড়াতে বেসরকারি মিলিশিয়ার আশ্রয় নিয়েছে চীন।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব পর্যবেক্ষণকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষক থান সোয়ে নাইংরয়ের মতে, ‘চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির সাবেক সদস্যদের নিয়ন্ত্রিত বাহিনী যদি মিয়ানমারে বৈধভাবে অস্ত্রধারণ করে কাজ করতে পারে, তবে এটি শুধু সামরিক উপস্থিতি নয় বরং সরাসরি প্রভাব বিস্তার। এতে স্থানীয় জনগণের মনে গভীর অনাস্থা জন্ম নিচ্ছে।’
তবে প্রশ্ন উঠেছে—এরা কি সত্যিই বেসরকারি?
চীনের এ প্রাইভেট বাহিনীগুলোর বিশেষত্ব হলো তারা নামমাত্র বেসরকারি হলেও বাস্তবে অনেক সময়ই সাবেক পিপলস লিবারেশন আর্মির কর্মকর্তাদের দ্বারা গঠিত এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নীতির ঘনিষ্ঠ অনুসারী। যেমন ডেউই সিকিউরিটি বা ফ্রন্টিয়ার সার্ভিসেস গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলোর ওপর রাষ্ট্রের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাদের বিদেশে নিয়োগ নিছক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারে সাড়া দেয়ার বিষয় নয়। বরং রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ যেখানে শক্তি প্রয়োগের দায়িত্ব ‘আউটসোর্স’ করলেও ন্যারেটিভ ও দায়ভার রাষ্ট্রের হাতে থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন ২০২৫ সালের এপ্রিলে একটি বিশ্লেষণে সতর্ক করে জানায়, ‘মিয়ানমারে চীনা প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোর ভূমিকা শুধু অবকাঠামোর নিরাপত্তা রক্ষায় সীমাবদ্ধ নেই। তারা এখন রাখাইনের মতো জাতিগত সংঘাতপীড়িত অঞ্চলে ডিজিটাল নজরদারি ও গোপন গোয়েন্দা তৎপরতায়ও যুক্ত হচ্ছে।’ লেমকিন ইনস্টিটিউটের মতে, ‘এটি নিছক বাণিজ্যিক নিরাপত্তা থেকে এক ধরনের ছায়া-রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে রূপ নিচ্ছে, যা মিয়ানমারের ভঙ্গুর সার্বভৌমত্বকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে। স্বচ্ছতা ও স্থানীয় জবাবদিহিতা ছাড়াই পরিচালিত এসব বিদেশী সশস্ত্র শক্তি দীর্ঘমেয়াদে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বাইরের প্রভাবকে গভীরতর করবে, অথচ কোনো আনুষ্ঠানিক সামরিক কিংবা কূটনৈতিক দায়ভার ছাড়াই।’
চীনের প্রাইভেট সিকিউরিটি অপারেশন কেবল মিয়ানমারেই সীমাবদ্ধ নয়, আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, এমনকি পাকিস্তানের বেলুচিস্তানেও এ ধরনের বেসরকারি বাহিনীর উপস্থিতির কথা শোনা যায়। তবে মিয়ানমারের মতো সরাসরি সংঘাতে তাদের সক্রিয়তা নতুন নজির স্থাপন করছে। বিদ্রোহীদের প্রতিরোধে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ, স্থানীয় সেনাবাহিনীকে সহায়তা, এমনকি জনগণের প্রতিও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সব মিলিয়ে এ প্রাইভেট বাহিনীগুলো এখন আর ‘নিরাপত্তা কোম্পানি’ নয়, বরং চীনের প্রভাব বিস্তারের নতুন অস্ত্র।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একসময় যে ঔপনিবেশিক বাহিনী এসেছিল বাণিজ্যের নামে, তারাও স্থানীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেই শক্তি গড়ে তোলে। এখন চীনা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও প্রায় একই কৌশল অনুসরণ করছে। প্রথমে অবকাঠামো, এরপর নিরাপত্তা, তারপর কৌশলগত অংশগ্রহণ। এতে মিয়ানমার সরকারের সার্বভৌমত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সেনা জান্তার দুর্বলতা ও বৈশ্বিক নিঃসঙ্গতা চীনকে আমন্ত্রণ জানাতে বাধ্য করেছে।
এ কৌশলে ঝুঁকি বেড়েছে চীনের জন্যও। চীনা নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি স্থানীয় জনগণকে ভীত করে তুলছে। আরাকান আর্মি বা অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী এ বাহিনীগুলোকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করছে। চীনের প্রতি তাদের ক্ষোভ বাড়ছে, নতুন করে চীনা স্থাপনার ওপর হামলার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। এতে চীনের বিনিয়োগ আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেমসটাউন ফাউন্ডেশন ও উইলসন সেন্টারের গবেষক নিভা ইয়াওয়ের মতে, ‘২০১৬ সালে চীনের সামরিক সংস্কার বহু সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে প্রাইভেট সিকিউরিটি খাতে ঠেলে দেয়। এরপর থেকেই চীনা প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় থাকা দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। যেখানে চীনের বিনিয়োগ যত বাড়ে, এসব নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিও তত বৃদ্ধি পায়। চীনের কোম্পানিগুলো বিআরআই অংশীদার দেশগুলোর অনেক জায়গায় ঝুঁকির মধ্যে থাকে, বিশেষ করে যেখানে চীনবিরোধী মনোভাব তীব্র। তাই নিরাপত্তা বাহিনী দরকার। ফলে বিদেশী সিকিউরিটি কোম্পানির বদলে চীন নিজের কোম্পানিই নিয়োগ দেয়। এর পেছনে উদ্দেশ্য হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা তৃতীয় কোনো দেশের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিরগিজস্তানে চীনা নিরাপত্তা কোম্পানিগুলো একসময় নিজদের প্রচার-প্রচারণা চালালেও স্থানীয়ভাবে সমালোচনার মুখে তা কমিয়ে আনে। স্থানীয় জনগণের অনাস্থা ও সংবেদনশীলতার কারণে তারা সেখানে নীরবে কাজ করছে।’
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, বিদেশী ভূমিতে নিরাপত্তা রক্ষার নামে হস্তক্ষেপের সীমা অস্পষ্ট হয়ে গেলে চীনের নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি মার খাবে। দক্ষিণ গোলার্ধের বহু দেশে চীনের সফট পাওয়ার দীর্ঘদিন ধরে যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভবিষ্যতে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এ প্রাইভেট বাহিনী চীনা সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকবে নাকি ‘আউটসোর্সড ফোর্স’-এর মতো একসময় নিজের গতিতেই চলতে শুরু করবে? যদি এ বাহিনীগুলো নিজেদের গতিতে কাজ করতে শুরু করে, তবে তা চীনের নিজের কৌশলগত পরিকল্পনায়ও বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে চীনের দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারে। চীনের বিদেশ নীতি বরাবরই ছিল ‘অ-হস্তক্ষেপ’ ও ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’-এর গল্প। কিন্তু এ প্রাইভেট আর্মির উপস্থিতি ভিন্ন আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। মিয়ানমারের এমন হস্তক্ষেপের পর কেউ চীনের উপস্থিতিকে নিছক উন্নয়ন বা বাণিজ্যিক সহযোগিতা হিসেবে নাও দেখতে পারে। কারণ এ বাহিনী ভূরাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছে যে চীনা বিনিয়োগ প্রশ্নাতীত, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগে তা রক্ষা করা হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, কিয়াকফিউ, মেইদ দ্বীপ, পাইপলাইন—সবকিছুরই গুরুত্ব অর্থনৈতিক হলেও চীনের প্রতিক্রিয়া এখন একেবারে কৌশলগত ও রাজনৈতিক। তারা শুধু নিজেদের স্থাপনা রক্ষা নয়, প্রয়োজনে হামলাকারীও হতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক স্টিমসন সেন্টারের গত জুনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরাসরি সেনা পাঠানো ছাড়াই প্রভাব বিস্তারের নতুন কৌশল নিয়েছে। বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনীগুলো চীনা অর্থায়নে নির্মিত অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক করিডোর রক্ষায় নিয়োজিত থাকলেও বাস্তবে তারা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও স্থানীয় কর্তৃত্বহীনতার ফাঁকে কার্যত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছে। কিয়াকফিউতে আরাকান আর্মির নিকটবর্তী এলাকায় চীনা প্রকল্প সুরক্ষায় এসব বাহিনী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র ভাড়া নেয়ারও সুযোগ পাচ্ছে। এ মডেল শুধু চীনের বিনিয়োগ রক্ষাই করছে না, বরং সামরিক উপস্থিতি ছাড়াই প্রভাব বিস্তারের এক প্রাতিষ্ঠানিক পথ খুলে দিয়েছে, যা শুধু মিয়ানমারের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের জন্যই একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে।