Bangla Tribune
আগামীকাল মহাষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে শুরু হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসব। ইতোমধ্যে রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গোৎসবের আমেজ। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে নগরীর ছোট বড় প্রতিটি পূজামণ্ডপ। ঝলমলে কাপড়ের আবরণে ফুটে উঠেছে এক অনন্য সৌন্দর্য। তার ওপর রঙ-বেরঙয়ের বৈদ্যুতিক লাইটের সমারোহ।
সরেজমিনে রাজধানী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রমনা কালীমন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, বনানী পূজামণ্ডপসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন মন্দিরে গিয়ে দেখা গেছে, পূজা উদযাপনের জন্য সকল প্রস্তুতি শেষ। মণ্ডপে মণ্ডপে গতকাল রাতেই দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ-কার্তিকসহ সব প্রতিমা চলে এসেছে। আগামীকাল মহাষষ্ঠীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সবাই।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে, এ বছর সারা দেশে ৩৩,৩৫৫টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর সেই সংখ্যা ছিল ৩১,৪৬১। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরে এবার ২৫৯টি পূজা মণ্ডপে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। গত বছর ঢাকা মহানগরে ২৫২টি পূজার আয়োজন হয়েছিল। সে হিসেবে মহানগরে সাতটি পূজামণ্ডপ বেড়েছে।
উৎসবমুখর পরিবেশে সবাইকে নিয়ে পূজা উদযাপন করতে চায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা
দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা নয়, বরং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন করতে চায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। দুর্গাপূজা উদযাপনের বিষয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌতম কুমার পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বছর ঘুরে আবারও আমাদের মাঝে বহুল প্রতীক্ষিত উৎসব দুর্গাপূজা এসেছে। আমরা সবাইকে নিয়ে সুন্দরভাবে পূজা উদযাপন করতে চাই।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আমরা চাই এ দেশটা হবে একটি অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যমুক্ত দেশ। এ দেশটা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার। প্রতিবছর পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আমাদের প্রত্যাশা এবার অন্তত এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটুক।’
দুর্গাপূজার আমেজের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্বী কুঁড়ি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাজধানীর প্রায় সকল পূজামণ্ডপ ঘুরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অনেক আনন্দ করেছি। আশা করি এ বছর আরও বেশি আনন্দ করবো।’
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যখন শুনি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে তখন খুব কষ্ট লাগে। আসলে এই ঘটনা কমবেশি প্রতি বছরই ঘটে। দুর্গাপূজা এলেই একদল এটাকে নিয়ে রাজনীতি শুরু করে। দেশটাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চায়। আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে কিন্তু আর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না। আমরা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে সুন্দরভাবে পূজা উদযাপন করতে চাই।’
দুর্গোৎসবের আমেজের সঙ্গে কিঞ্চিৎ শঙ্কা-আক্ষেপ সনাতন ধর্মাবলম্বী নেতাদের
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতারা বলছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজায় কোনও মন্দির-মণ্ডপে হামলার ঘটনা তারা দেখতে চান না। একই সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জান-মালের ওপর হামলার সঙ্গে যারা জড়িত সরকার তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি দেবে বলেও প্রত্যাশা তাদের।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, ‘দুর্গাপূজার প্রস্তুতির মধ্যেই কয়েকটি জেলায় দুর্গাপ্রতিমা ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। জেলাগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহের শৈলকূপা, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, নাটোর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।’
জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, ‘পূজার মধ্যে আমরা এসব হামলা দেখতে চাই না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ নয়, রাষ্ট্রের আলোকিত চেতনা ও সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে এই সহিংসতার অবসান ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে বলতে চাই, শুধু পূজার পাঁচ দিন নয়, বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়তে চাইলে ৩৬৫ দিনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। দুর্বৃত্তদের বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমরা দেখতে চাই।’
এদিকে নির্বিঘ্নে দুর্গাপূজা উদযাপন ক্রমান্বয়ে আশঙ্কা ও উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি। গতকাল (২৬ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানান, নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গোৎসব উদযাপনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চতর পর্যায় থেকে পূজার্থীদের আশ্বস্ত করা হলেও পূজার প্রাক্কালে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা কোনোভাবেই আশান্বিত হতে পারছেন না।
দুর্গোৎসব উপলক্ষে দেশব্যাপী কঠোর নিরাপত্তার উদ্যোগ প্রশাসনের
শারদীয় দুর্গাপূজা–২০২৫ উপলক্ষে দেশব্যাপী বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা দুর্গাপূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে র্যাব জানায়, পূজা যেন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
র্যাবের মিডিয়া শাখা থেকে জানানো হয়েছে, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নাশকতা প্রতিরোধে রাজধানীতে র্যাবের ৯৪টি টহল দল এবং সারা দেশে ২৮১টি টহল দল কাজ করছে। এছাড়া ব্যাটালিয়নগুলো নিজ নিজ কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে স্থানীয় পূজা কমিটি, জনপ্রতিনিধি এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এদিকে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি পর্বে তুচ্ছ কিছু ঘটনা ঘটলেও পুলিশ সেগুলো অবহেলা করছে না। যেকোনো বিচ্যুতি বা নাশকতার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেন, ‘প্রস্তুতি পর্বে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমার হাত বা মাথা নষ্ট করার ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। খবর পাওয়ামাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, কোনোটাই অবহেলা করছি না। বিচ্যুতি হলে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি, মামলাও করছি।’
উল্লেখ্য, আজ (২৭ সেপ্টেম্বর) দুর্গাপূজার বোধন। আগামীকাল রবিবার ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠী। ২৯ সেপ্টেম্বর সোমবার মহাসপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী ও ১ অক্টোবর মহানবমী, ২ অক্টোবর বিজয়া দশমী, বিসর্জন। সেদিন বিকেল তিনটায় ঢাকাসহ সারা দেশে বিজয়ার শোভাযাত্রা শুরু হবে।