রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়লে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শঙ্কা

Bangla Tribune

বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খুন, গুম, নারী নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বিশেষ করে বিগত সরকারের আমলে বিরোধী দল ও মত দমনে পুলিশ-র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করা হয়েছে। যার প্রকাশ ঘটেছে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ওপর বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের হামলার মধ্য দিয়ে। এতে ভেঙে পড়েছিল বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের বেশিরভাগ কাঠামো। মানবাধিকার পরিস্থিতি সুরক্ষিত রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঠিক বিচার করা। কিন্তু দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির ছিল না। এতে বিগত সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা মনে করছেন, নতুন বছর ২০২৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গত চার মাসে গুমের মতো কোনও ঘটনা না ঘটলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বা রাজনৈতিক সরকারের আমলের চেয়ে এখন ভালো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে নতুন বছরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো চাঙা হয়ে উঠতে পারে। সেসময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় না আনায় নানামুখী অপরাধে জড়িয়েছেন তারাও। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তাদের সঙ্গে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গুলি করার ঘটনাও অতীতের অপরাধের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়ার চেষ্টার কারণে হয়েছে। ফলে অতীতের কথা মাথায় রেখে বর্তমান সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আইন প্রয়োগের কাজটি করতে হবে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিনা বিচারে ১ হাজার ৯২৬ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। গুম হয়েছেন সাত শতাধিক ব্যক্তি। এখনও প্রায় ২০০ জন নিখোঁজ। এর বাইরে পতিত সরকারের শেষ সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমান সরকার (অন্তর্বর্তী) গঠিত গুম কমিশনের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসব ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা।

সম্প্রতি গুম কমিশনের প্রকাশিত আংশিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরের এক হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি অভিযোগ। ‘গুম সংস্কৃতি’ বা জোরপূর্বক অন্তর্ধানের সংস্কৃতি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পদ্ধতিগতভাবে নকশা করা হয়েছিল। সিংহভাগ গুমের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে। পুলিশ, র‌্যাব ও ডিজিএফআইসহ আরও কয়েকটি বাহিনীর নাম উঠে এসেছে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে। বাহিনীগুলো নিজেদের মধ্যে ভুক্তভোগীদের বিনিময় করতো, একটি বাহিনী অপহরণ করতো, অন্যটি কারারুদ্ধ করতো, তৃতীয়টি হত্যা করতো বা ভুক্তভোগীদের মুক্তি দিতো।

মানবাধিকারকর্মী এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বলেন, বিগত সময়ের সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে দায়মুক্তিহীন ও বিচারবহির্ভূতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিকে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। এই সময়ে গুমের কোনও ঘটনা না ঘটলেও কয়েকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে বিগত সময়ের তুলনায় বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেকটা ভালো অবস্থায় আছে।

গেলো ১৫ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণের ফলে গণঅভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময়ে লাগবে। এই সরকার জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিভুক্ত, তারা কিছু সংস্কার করবে। সেটা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিরোধী দল সবারই চাহিদা। তবে আগামীতে নির্বাচনের জন্য যারা আন্দোলন করবে এবং একই সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে মানবাধিকার পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে।

তাছাড়া নতুন বছরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের মাঠের রাজনীতি এবং তাদের দমনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নতুন বছর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল, মিটিং ও আন্দোলন। আন্দোলনে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে তা নিয়ন্ত্রণে শক্তি প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এমন পরিস্থিতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের আইনে মধ্যে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনও মব বা অপ্রীতিকর কোনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশের অনেক বেগ পোহাতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার প্রয়োজন। কেননা ৫ আগস্ট পুলিশের ভুলের কারণে ও কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য বাহিনীটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ মানুষের মতো অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। বর্তমানে পুলিশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আর রাজনৈতিক দলগুলো যদি আগের মতো সুযোগ নিতে চায়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

এসব পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক। তিনি বলেন, বর্তমানে মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। নতুন বছরের শেষের দিকে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কিছুটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও উন্নত করতে না পারলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। তবে পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, রাজনৈতিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। সেটা হয়তো বছরের প্রথম দিক থেকে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *