Google Alert – সশস্ত্র
চাঁদাবাজি, মাদক, কিশোর গ্যাং, জমি দখল— রাজধানীর আদাবর ও মোহাম্মদপুরে ত্রাসের আরেক নাম মনোয়ার হোসেন জীবন ওরফে লেদু হাসান। কোনো কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না তাকে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় এক সময়ের দরিদ্র কৃষকের সন্তান আজ ভয়ংকর এক অপরাধ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক।
কে এই মনোয়ার হোসেন জীবন ওরফে লেদু হাসান?
নামের আগে এখন ‘বিএনপি নেতা’ তকমা থাকলেও প্রকৃত পরিচয়— তিনি একজন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রক। তার বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, হামলা, মাদক ও চাঁদাবাজির একাধিক মামলা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দল কিংবা প্রশাসন— কোনো কিছুই যেন তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
আদাবর থানা বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক লেদু হাসান সম্প্রতি আলোচনায় আসেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও এক সময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী মেজর (অব.) মঞ্জুরুল কাদেরের সম্পত্তি দখলের চেষ্টা এবং ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায়। এই অভিযোগে থানায় একটি মামলা হয়। তবে সেখানে লেদু হাসানের নাম বাদ রেখেই মামলা হয়েছে। চাঁদা না দেওয়ায় মঞ্জুরুল কাদেরের সম্পত্তি দেখভালকারী কেয়ারটেকার মিলনের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায় লেদু হাসান ও তার লোকজন। মারধরের শিকার হয়ে মিলন হাসপাতালে ভর্তি হন এবং পরে আদাবর থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন।
এজাহারে বলা হয়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিকালে শেখেরটেকের রোড ৩ এর ২২ নম্বর বাসায় প্রবেশ করেন লেদু ও তার দলবল। তার সঙ্গে ছিল মো. সাগর, আকবর, তালুকদারসহ ৭/৮ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। তারা বাড়িতে ঢুকে মিলনের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। মিলন রাজি না হলে তাকে লাঠি ও ইট দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। এই ঘটনায় হওয়া মামলায় কৌশলগত ভাবে কারণে বাদ যায় লেদু হাসানের নাম।
বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়া বলেন, ‘সম্প্রতি চাঁদাবাজির ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। আমরা অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি।’ লেদু হাসানের নাম না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাদী কোনো কারণে দেননি।’
এদিকে ২১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় লেদু হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করেন মোহাম্মদ সোলাইমান নামের এক ব্যক্তি। লেদু হাসান চন্দ্রিমা মডেল টাউন হাউজিংয়ে সোলাইমানের জমি দখলের চেষ্টা ও চাঁদাবাদি করে। পাশাপাশি সেখানে ভবন তৈরি করতে রাখা রড, সিমেন্ট নিয়ে চলে আসে। এসময় লেদু হাসানের সন্ত্রাসী বাহিনী জমির সীমানা প্রাচীর ভাঙচুর করে। এই ঘটনা লেদু হাসানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
মঞ্জুরুল কাদের কিংবা মোহাম্মদ সোলাইমানের সম্পত্তি দখলের ঘটনাই প্রথম নয়। দীর্ঘদিন ধরেই লেদু হাসান আলোচনায় নানান কারণে। বিশেষ করে আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় তার নাম শুনলেই অনেকে আতঙ্কে চুপসে যান। চাঁদাবাজি, মাদক, জমি দখল, কিশোর গ্যাং, স্থানীয় রাজনীতি— সবখানে তার প্রভাব। অথচ কেউ যেন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। রাজনৈতিক পরিচয়ই যেন তার একমাত্র ঢাল।
লেদু হাসানকে দল থেকে একবার বহিষ্কার করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর, আদাবরে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই বহিষ্কারাদেশ রহস্যজনকভাবে প্রত্যাহার হয়ে যায়। তারপর থেকে তার দাপট যেন আরও বেড়ে যায়।
এই লেদু হাসানই আদাবরে কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি ১ সেপ্টেম্বর রাতে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া এক তরুণকে কিশোর গ্যাং সদস্যরা জিম্মি করে। গ্যাং লিডার পলাশের নেতৃত্বে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরিবার পুলিশকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে কিশোর গ্যাংয়ের লিডার জনি-রনির মা রেজ্জেকা বেগম পুলিশের ওপর মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয় এবং গ্যাং সদস্যরা পুলিশসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করে। ভাঙচুর করে পুলিশের গাড়িও। এই গ্যাংয়ের নেতৃত্বে থাকা জনি ও রনি, কব্জি কাটা আনোয়ার নামের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর ঘনিষ্ঠ। আর এই আনোয়ার এবং তার গ্যাংকে মদদ দেন লেদু হাসান— এমন অভিযোগ করছে পুলিশ।
এখানেই শেষ নয়। আদাবরের একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, লেদু নিয়মিত তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। তার কথিত অডিও রেকর্ডও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমি আদাবর থানা বিএনপির মা-বাপ, আমি যা বলব তাই হবে। যত টাকা চাইব, তত টাকাই দিতে হবে। থানা-পুলিশে অভিযোগ দিলে টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। আমার কথা না শুনলে ভয়ংকর হবে।” এসব কথার পাশাপাশি অশ্লীল গালিগালাজও শোনা যায়।
এমনকি, থানায় ঢুকে এক নারী বাদীকেও হুমকি দেন তিনি। বলেন, “একদম চুপ! একদম চুপ; না হলে কিন্তু একদম ঢোকায় দিমু, জিন্দিগি বরবাদ করে দিমু।” এসব ঘটনায় থানার সিসিটিভি ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও তাকে গ্রেপ্তারে তেমন অগ্রগতি নেই।
মাদকের দিক থেকেও তার রয়েছে একচ্ছত্র প্রভাব। আদাবর, মোহাম্মদপুর, শনিরবিল, শেখেরটেক, জেনেভা ক্যাম্প, জহুরী মহল্লা, বিহারী কটারসহ বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা— সবকিছুর সিন্ডিকেট পরিচালনা করে সে। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালে আদাবরের ছাত্রনেতা মশিউর রহমান মশুকে ইয়াবা ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় তার বাবা মামলা করেন লেদু, মোল্লা স্বপন, সেলিম, সাগরসহ ৮ জনকে আসামি করে।
এই সন্ত্রাসী রাজত্ব গড়ে তুলতে সময় নিয়েছেন প্রায় দুই দশক। একসময় রাজধানীর জহুরী মহল্লায় বস্তিতে পরিবারসহ আশ্রয় নেওয়া লেদু ছিলেন এক দরিদ্র কৃষকের ছেলে। তার বাবা হারিজ বেপারী ঢাকায় এসে রিকশা চালাতেন। লেদুর বড় ভাইও রিকশা চালাতেন। বোনদের বিয়ে দেওয়া হয় রিকশা চালক, রাজমিস্ত্রি, গাড়িচালকের সাথে। মা-বোনেরা ফুটপাতে টং দোকান বসিয়ে চা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। সেই ছোটবেলার দারিদ্র্য থেকেই উঠে আসেন তিনি। মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে, কিশোর বয়সে ছাত্রলীগ, পরে যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেন। হয়ে ওঠেন ক্যাডার। চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, খুন, অস্ত্র, মাদক—সবকিছুর সঙ্গে তার নাম জড়ায়।
২০০১ সালের পর ‘কন্ট্রাক্ট কিলার’ হিসেবে পরিচিতি পান। ঢাকা মহানগর উত্তরের এক ছাত্রনেতাকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর একাধিকবার গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগে স্থান না পেয়ে জেল থেকেই বিএনপিতে যোগ দেন। ২০১০ সালে ওহিউদুজ্জামান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন, ২০১২ পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে আদাবর ও মোহাম্মদপুরের সব আলোচিত কিশোর গ্যাংয়ের ‘বড় ভাই’ তিনি। কব্জি কাটা আনোয়ার, এক্সেল বাবু, কিলার বাদল, কিলার লাল্লু, জনি-রনি, গাংচিল বাহিনীর লম্বু মোশারফ— এসব গ্রুপের অধিকাংশ নেতা কারাগারে থাকলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ এখন লেদুর হাতেই। তার নির্দেশেই চলে এসব গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাকে ছোঁয়া যায় না। আবার রাজনৈতিক দলের নেতারাও মুখে কিছু বললেও, কার্যত তার বিরুদ্ধে কোনো কঠোর অবস্থান নেয় না। আদাবরে একাধিকবার পুলিশের উপস্থিতিতে ঘটনাও ঘটেছে, কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার হতে হয়নি কখনো।
স্থানীয়দের অভিযোগ, থানা ও রাজনৈতিক দল— দুটোরই ছায়াতলে লেদু হাসান দিনের পর দিন অপরাধ করে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর, আদাবর থানাসহ বিভিন্ন থানাতে হত্যা চাঁদাবাজি সহ প্রায় ২ ডজন মামলা রয়েছে। তবুও ধরা ছোঁয়ারে বাইরে রয়েছে লেদু হাসান। তাকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি ভুক্তভোগীদের।
তবে অভিযোগ বিষয়ে বিএনপি নেতা মনোয়ার হাসান জীবনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, আমরা তার বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখছি। কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমরা তাকে আইনের আওতায় আনবো।’