রাশিয়া চার দিনেই নিষিদ্ধ, ইসরায়েল দুই বছরেও কেন নয়?

Independent Television

মোহামেদ সালাহ কি তাঁর বালন দ’র জেতার যা-ও কিছু সম্ভাবনা ছিল, অতটুকুর জলাঞ্জলি দিয়ে দিলেন? কাগজে-কলমের হিসেবে প্রশ্নটার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। বছরের সেরা ফুটবলারের পুরস্কারটা দেবে ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন। এবারের বালন দ’রের দৌড়ে সালাহ যে সম্ভাবনার দৌড়ে একেবারে সবার ওপরে ছিলেন–এমনও নয়। লিভারপুলের মিশরীয় ফরোয়ার্ডকে নিয়ে প্রশ্নটা উঠছেও মানবিকতার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক ইঙ্গিতবাহী এক পোস্টের কারণে। আর খেলার সঙ্গে রাজনীতি না মেশানোর গর্ব তো ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন। গর্বটা ছদ্মবেশি কি না, সে ভিন্ন প্রশ্ন।

 

কিন্তু সালাহকে নিয়ে প্রশ্নটা উঠছে কেন? 

 

গত ৬ আগস্ট মারা গেছেন ফিলিস্তিনের সাবেক ফুটবলার সুলেইমান আল-ওবায়েদের, ভালোবেসে যাঁকে ‘ফিলিস্তিনি পেলে’ ডাকতেন যুদ্ধে নিপীড়িত দেশটার মানুষ। ফুটবলার পরিচয়টা না থাকলে আল-ওবায়েদের মৃত্যুর ঘটনা দুই বছরে গড়াতে যাওয়া যুদ্ধে ষাট হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যুর ট্যালিতে একটা বাড়তি দাগের বেশি কিছু হয়তো হতো না। ফিলিস্তিনে ফুটবল খেলে আর কীই-বা পেতেন, দুই বছরে গড়াতে যাওয়া যুদ্ধে গত কয়েক মাসে ইসরায়েল-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে দেশের আরও লাখো মানুষের মতো আল-ওবায়েদও স্ত্রী আর পাঁচ সন্তানের পরিবার নিয়ে সয়েছেন ক্ষুধার যন্ত্রণা। ত্রাণ পৌঁছানোর খবরে ছুটে গিয়েছিলেন, সেখানেই ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় মারা গেছেন।

 

ফুটবলার পরিচয় ছিল বলেই, তাঁর মৃত্যুর ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হলো আলাদা করে। ফুটবলবিশ্বে আহা-উহু হলো, তার রেশ হয়ে এল আল-ওবায়েদকে নিয়ে ইউরোপের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা উয়েফার এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে একটা মানবিক পোস্ট। ‘বিদায়, সুলেইমান আল-ওবায়েদ, ফিলিস্তিনি পেলে’ দিয়ে শুরু দুই বাক্যের বিবৃতি, যা তিনি অন্ধকার এই সময়েও শিশুদের আশার আলো দেখিয়েছেন জানিয়ে শেষ। উয়েফার মতো সংগঠনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাও অযৌক্তিক। কারণ, তারা খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশায় না।

 

সালাহর এতে মন ভরেনি। মানবিকতার ‘মাছ’ ধরলেও এর পেছনের রাজনীতির ‘পানি’ না ছোঁয়া উয়েফার এই বিবৃতি রি-শেয়ার করে সালাহ দশ শব্দের ইংরেজি বাক্যে তিনটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন–‘এটা কি একটু বলবেন যে, তিনি কীভাবে মারা গেলেন, কোথায় মারা গেলেন এবং কেন মারা গেলেন?’

 

উয়েফা উত্তর দেবে না। চাইলেও হয়তো পারবে না, তাদের হাত-পা বাঁধা। কিন্তু উত্তরগুলো সবার জানা।

 

গাজায়, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায়–সালাহর কোথায় আর কীভাবে’র উত্তর। ‘কেন’র উত্তরটা জটিল, তার সরল ব্যাখ্যা হতে পারে এই–জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংঠনগুলোর হুঁশিয়ারিকে কাঁচকলা আর যুদ্ধবিষয়ক রীতিনীতিকে বিশেষ একটি আঙুল দেখিয়ে যুদ্ধ ছাপিয়ে যে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল, তার শিকার আল-ওবায়েদ। এবং আরও ষাট হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। সালাহর ছোট্ট তিনটি প্রশ্ন মানবিকতার ফাঁকা বুলিকে পাশ কাটিয়ে এই রাজনীতির খেলাকে টেনে আনে আলোচনার টেবিলে।

 

নীতিকথার মুখোশের পেছনে ঠিকই সমান্তরালে চলতে থাকা রাজনীতি আর খেলার যোগসূত্রবিষয়ক আলোচনার গোলটেবিলটাতে আগে থেকেই বড় বড় আরও এত প্রশ্ন ঘুরছে যে, সালাহর বালন দ’র পাওয়া-না পাওয়ার প্রশ্নটা সেখানে নগন্য। প্রশ্নগুলো ইসরায়েলের অনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন আর তাদের নিষেধাজ্ঞার দাবিতে ফিফা আর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) মতো সংগঠনগুলোর কালক্ষেপণ নিয়ে। সংগঠনগুলোর দ্বিচারিতা নিয়ে–চলমান দুই যুদ্ধে আগ্রাসী পক্ষগুলোর মধ্যে রাশিয়া যেখানে দ্রুতই খেলার মাঠে নিষিদ্ধ হয়ে গেল, যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে থাকায় বেলারুশকেও নিষিদ্ধ হতে হলো, সেখানে ইসরায়েলের আগ্রাসন কেন এত বছরেও প্রশ্রয় পাচ্ছে?

 

দুই.

 

মোটা দাগে দেখলে দুটি যুদ্ধের শুরুর ঢংটা একই। রাশিয়া হামলা করেছে ইউক্রেনের সামরিক প্রভাব আর নাৎসিবাদের উত্থান ঠেকানোকে কারণ দেখিয়ে, গাজায় হামলার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বয়ান ছিল সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হামাসকে উৎখাত করা।

 

দুটি যুদ্ধে প্রভাবশালী পক্ষের আসল ইচ্ছাটাও কাছাকাছি। এরই মধ্যে ইউক্রেনের ২০ শতাংশ অঞ্চল দখলে নেওয়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের দিন ফেরানোর স্বপ্নের কথা অনেক আগেই জানিয়েছেন। আর সপ্তাহ দুয়েক আগে গাজার দখল নেওয়ার পরিকল্পনার ঘোষণা দেওয়া ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দিন চারেক আগে জানালেন তাঁর বড় স্বপ্নের কথা–ফিলিস্তিন ছাড়িয়ে জর্ডান আর মিশরের অংশ নিয়ে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ বা প্রমিজড ল্যান্ড। 

 

যুদ্ধক্ষেত্রে দুই পক্ষের উদ্দেশ্য আর বিধেয় যখন কাছাকাছি ঢঙের, তাহলে ফিফা আর আইওসির আদালতের রায়ে রাশিয়া শাস্তি পেলেও ইসরায়েল বারেবারে জামিন পাচ্ছে কেন? প্রশ্নগুলো জোর আওয়াজ পায়, যখন রাশিয়া আর ইসরায়েলের ক্ষেত্রে বিশ্বের ক্রীড়াক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় দুই সংগঠনের দুই চোখা নীতি দৃশ্যমান হয়।

 

আইওসি প্রেসিডেন্ট থমাস বাখের (বামে) সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ফিফার সাবেক প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাতার (ডানে)। ছবি রয়টার্সফিফা রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করেছে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর চার দিনের মাথায়। উল্টোদিকে ইসরায়েল দুই বছর ধরে গাজায় হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরও ফিফায় তারা বহাল-তবিয়তে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপের কয়েকটা দেশের আপত্তিই যথেষ্ট হয়ে গেল, ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ফিফার দরবারে ফিলিস্তিনের একের পর এক প্রস্তাব-অনুযোগ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তদন্ত প্রতিবেদনও পাত্তা পাচ্ছে না।

 

আইওসি ২০২৩ সালের অক্টোবরে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করার সময়ে তাদের অ্যাথলেটদের ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে প্যারিস অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার যে সুযোগ রেখেছে, সেখানে ‘নিরপেক্ষতা’র শর্ত ইউক্রেন হামলাকে সমর্থন না করা। অথচ ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘আনন্দের সঙ্গে, আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য’ লিখে সমালোচিত ইসরায়েলি অ্যাথলেট পিটার পাল্টশিকের ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে ইসরায়েলের পতাকাবাহক হওয়ার পথে কোনো বাধা আসেনি!

 

তিন.

 

কেন এই দ্বিচারিতা? উত্তরের খোঁজে ফিফা-আইওসিকে ঢালাওভাবে কাঠগড়ায় তোলার আগে কিছু বিশ্লেষণ জরুরি। মানবিকতার প্রশ্নে ইসরায়েলকেও রাশিয়ার মতো শাস্তি না দেওয়া অনৈতিক মনে হতে পারে, কিন্তু কাগজে-কলমে বাঁধা আইন অনুযায়ী সেটা কি অবৈধ? আইন অনুযায়ী ফিফা-আইওসির কী করা সম্ভব ছিল আর তারা কতটুকু করেছে? যা করেনি, তার পেছনে কারণটা কী?

 

ইউক্রেনে আক্রমণের পর ফিফা বা আইওসি কিন্তু প্রাথমিকভাবে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করতে চায়নি। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো আইওসির ঢঙে রাশিয়ার জাতীয় দল আর ক্লাব দলগুলোকে ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে খেলানোর পক্ষে ছিলেন। ঝামেলা বেঁধে যায় ১২টি দেশ রাশিয়া ও বেলারুশের বিপক্ষে খেলবে না বলে জানিয়ে দেওয়ায়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন পর মার্চেই ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের ইউরোপিয়ান অঞ্চলের বাছাইপর্বের প্লে-অফে পোল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচ ছিল রাশিয়ার, গ্রুপে অন্য দুই দল ছিল সুইডেন ও চেক প্রজাতন্ত্র। ওই তিন দেশসহ ১২টি দেশ একসঙ্গে আপত্তি জানানোয় ফিফা পড়ে গেল বিপদে, রাশিয়াকে খেলতে দিতে চাইলে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সূচিই শেষ করা যায় না! ফল? রাশিয়া নিষিদ্ধ! 

 

রাশিয়ান অ্যাথলেটরা প্যারিস অলিম্পিকে নিজ দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেননি। তাঁরা অংশ নিয়েছেন নিরপেক্ষভাবে। ছবি: টুইটার আইওসি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া ‘অলিম্পিক ট্রুস’ ভাঙার কারণে। অলিম্পিক ট্রুস অনুযায়ী অলিম্পিক এবং এর ঠিক আগে-পরের সময়টুকুতে যুদ্ধে জড়ানো নিষেধ, যাতে অ্যাথলেটরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে অলিম্পিকে নামতে পারেন। রাশিয়া সে নিয়ম ভেঙেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া, তখন বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিক প্রায় শেষের পথে, মার্চে শুরু হওয়ার কথা ছিল প্যারা–অলিম্পিক। শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর রাশিয়াকে আইওসির নিষেধাজ্ঞার দেওয়ার কারণও আইনসিদ্ধ–রাশিয়ার অলিম্পিক কমিটি তার এক সপ্তাহ আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা চার অঞ্চল লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, খেরসন ও ঝাপোরিঝিয়াকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে, যা অলিম্পিক চার্টারের লঙ্ঘন। হিসেবটা সহজ, ওই অঞ্চলগুলোকে দখল করার ঘোষণা রুশ সরকারের যুদ্ধের কৌশল হতে পারে, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আগে রুশ অলিম্পিক কমিটির ওই চার অঞ্চলকে নিজেদের বলে ঘোষণা দেওয়া তো আইওসি মেনে নেবে না!

 

পাল্টা প্রশ্ন উঠতে পারে, ইসরায়েলও কি একই অপরাধ করেনি? এখানে বাস্তবতার হিসেব আর কাগজে-কলমের প্রমাণ একটু ঝামেলা পাকাচ্ছে।

 

ফিফা রাশিয়াকে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর কারণে নিষিদ্ধ করেনি। তাদের নিয়ম ও ইতিহাস বলছে, তারা সেটা কখনো করবেও না। তেমন কিছু করতে গেলে বিশ্বজুড়ে যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রেই ফিফাকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপে পড়তে হবে–এই লেখাই যেমন–একটা যুদ্ধে (রাশিয়া) সিদ্ধান্ত নিলেও আরেকটা যুদ্ধে (ইসরায়েল) কেন নেওয়া হয়নি তা নিয়ে! নিজেদের এসব হিসেবের উর্ধ্বে রাখতেই ফিফা যুদ্ধকে রাজনৈতিক বিবেচনায় হিসেবের বাইরে রাখে। ইতিহাসও বলছে, এ পর্যন্ত খেলাধুলার বাইরের কারণে শুধু তিনটি দেশকেই নিষিদ্ধ করেছে ফিফা–বর্ণবাদের কারণে সাউথ আফ্রিকাকে (১৯৬১-১৯৯২ পর্যন্ত দুই দফায়), জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে মিল রেখে যুগোস্লাভিয়াকে (১৯৯২), আর রাশিয়াকে (২০২২)।

 

আগের দুটি দেশের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটা নিয়ে বিতর্কের কিছু ছিল না। বর্ণবাদ মানবাধিকারের লঙ্ঘন, সেটাও সাউথ আফ্রিকা দেশ হিসেবে অনুসরণ করলে ফিফা কিছুই বলত না, তারা সাউথ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ করেছে তাদের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনও দল নির্বাচনে বর্ণবাদী প্রক্রিয়া অনুসরণ করায়। আর জাতিসংঘই কোনো দেশকে নিষিদ্ধ করে রাখলে ফিফারও তো সে অনুযায়ীই চলতে হবে। কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারটা ভিন্ন, সেটা দুটি দেশের–বা তাদের পেছনে থাকা আরও কিছু দেশের রাজনৈতিক চালের ফল। আর রাজনীতি ও খেলাকে তো ফিফা এক পাত্রে মেশায় না!

 

রাশিয়া আর ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ফিফার সিদ্ধান্ত দুরকম হয়েছে পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে। রাশিয়ার বিপক্ষে খেলতে কয়েকটি দেশ আপত্তি জানানোয় ফিফার সূচিই ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়ে, ইসরায়েলের ক্ষেত্রে তো সে ঝামেলা নেই। ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ চাইছে মূলত এশিয়া আর আফ্রিকার আরব দেশগুলো। ইসরায়েল তো ইউরোপিয়ান ফুটবলের (উয়েফা) অংশ, এশিয়া আর আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে তাদের দেখা বিশ্বকাপের বাইরে সম্ভব নয়। আর ইসরায়েল ১৯৭০ সালের পর কখনো বিশ্বকাপে সুযোগ পায়নি বলে প্রশ্নটাই ওঠেনি। বাকি থাকে ইউরোপিয়ান ফুটবল, তারা ইসরায়েলের বিপক্ষে কখনো দাঁড়ায়নি। দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও শূন্য বলে দেওয়া যায়। এর পেছনে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া, ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক বড় প্রভাব রেখেছে ঠিকই, কিন্তু সে রাজনীতি থাকে খেলার মাঠে মুখোশের আড়ালে।

 

আইওসির ইতিহাসে যুদ্ধে জড়ানো দেশকে নিষিদ্ধ করার উদাহরণ আছে, তবে তার সবই প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেন্দ্রিক। রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করার পেছনেও তাদের আনুষ্ঠানিক কারণ তো যুদ্ধ নয়, অলিম্পিক চার্টারের লঙ্ঘন। তাহলে ইসরায়েল? তাদের ইস্যুটাকে চাইলে গুপ্ত রাজনীতির সঙ্গে মেলানো যায়। ইসরায়েল গাজা দখল করছে, কিন্তু রাশিয়ার মতো ঘোষণা দিয়ে গাজাকে নিজেদের অংশ বলে তো দাবি করেনি ইসরায়েলের অলিম্পিক কমিটি! আইওসির পক্ষে তাই চোখ বুজে থাকা সহজ। গত বছরের জুলাইয়ে আইওসি সরাসরি বলেই দিয়েছে, ইসরায়েল আর রাশিয়ার ঘটনা দুটি একই নিক্তিতে মাপা যাচ্ছে না। একই কথা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন উয়েফার সেক্রেটারি জেনারেল থিওডর থিওডরাডিস–‘দুটি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।’

 

চার.

 

কিন্তু আনুষ্ঠানিক এসব ব্যাখ্যা কি পুরোটা বলে? উত্তর–না! ব্যাখ্যার আড়ালে থাকা বিশ্লেষণ কী বলে, সে খোঁজে গেলে দেখা যাবে, রাজনীতি আর খেলার সম্পর্কটা মোটেও তেল আর জলের নয়। 

 

ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সঙ্গে আইওসি প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ। ছবি: রয়টার্সআইওসি বারবারই ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে হাইকোর্ট দেখিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছে, আর ফিফা সময়ক্ষেপণকে নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। ফিলিস্তিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের মে মাসে ব্যাংককে ফিফার কংগ্রেসের অ্যাজেন্ডায় ছিল ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা, কিন্তু অন্য সব সিদ্ধান্তের বেলায় নিজের ইচ্ছাকেই শেষ পর্যন্ত রায়ে পরিণত করতে সিদ্ধহস্ত ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো সেবার কংগ্রেসে ২১১ দেশের সদস্যদের উপস্থিতিতে ‘ফুটবল আর কতটুকুই করতে পারে’ বলে আক্ষেপ জানালেন। আর সিদ্ধান্ত? জানালেন, আরও আইনি বিশ্লেষণ করে ফিফা ২০ জুলাইয়ের কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেবে। ২০ জুলাই এল, ইনফান্তিনো জানিয়ে দিলেন, আইনি বিশ্লেষকদের প্রতিবেদনের জন্য দুই পক্ষের দিক থেকেই আরও প্রমাণাদির দরকার, সময় চাইলেন ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। যদিও তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি গ্লোবাল ইস্যুটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সূত্র জানিয়ে লিখেছে, ইনফান্তিনো মিথ্যা বলেছিলেন। ২০ জুলাইয়ের কংগ্রেসের এক সপ্তাহ আগেই নাকি ফিফার আইনি বিশ্লেষকরা তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন! টিআরটি গ্লোবালের এই প্রতিবেদন আরও গুরুত্ব পায়, যখন ফিফার এই ‘মিথ্যাচারে’র সঙ্গে প্যারিস অলিম্পিকের ফুটবলে ইসরায়েলের খেলার সময় মিলে যায়। ১৯৯৪ সালে উয়েফার অংশ হওয়ার পর সেবারই প্রথম অলিম্পিকে জায়গা করে নেয় ইসরায়েল। এদিকে ২০ জুলাই ফিফা ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া পেছাল, ওদিকে ২৪ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অলিম্পিক ফুটবলের গ্রুপপর্বে নেমে গেল ইসরায়েল! 

 

অলিম্পিক শেষে আগস্ট পেরিয়ে অক্টোবরে ফিফা জানাল, এইবারে তাঁহারা তদন্ত করিবেন! তদন্তের প্রতিবেদন এল এই বছরের ২৬ জুন, যা অনেক আগে থেকে সর্বজনবিদিত তথ্যই আরেকবার জানাল–ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে আরও অনেক মানুষের মতো ইসরায়েলের ৮টি ফুটবল ক্লাবও দখলদারি চালাচ্ছে, ইসরায়েলি লিগের ম্যাচ ওই ক্লাবগুলো খেলে পশ্চিম তীরে! এই তদন্তে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধের চাপ আসে না সরাসরি, তবে ফিফার ওপর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ কিছুটা বাড়ে।

 

এই চাপ সামলানোর অভিজ্ঞতা অবশ্য ফিফার অনেক দিনের। ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার ইস্যুতে এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের রক্তক্ষয়ী হামলার সময়েও ফিলিস্তিন ফিফার দরবারে গিয়েছিল, এবং সেবারই সম্ভবত ইসরায়েলকে সবচেয়ে বেশি চাপে ফেলতে পেরেছিল তারা। ২০১৫ সালের মে মাসে ফিফা কংগ্রেসে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে ভোটের কথাবার্তাও হয়ে গিয়েছিল, তিন-চতুর্থাংশ ভোট পক্ষে গেলেই ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার চাপ সামলানো কঠিন হয়ে যেত ফিফার জন্য। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে দাবি তুলে নেয় ফিলিস্তিনই! 

 

কেন? ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জিব্রিল রাজুবের ব্যাখ্যা ছিল, ‘আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমাকে বলেছেন যে, তাঁরা অন্য একটা দেশকে নিষিদ্ধ করার মতো উদাহরণ তৈরি হতে দেখতে চান না।’ উল্টো সেবার কংগ্রেস শেষ হলো ইসরায়েলকে ফিফার ‘এসব আর করবে না’ ঢঙের বকুনির পর ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের দুই সভাপতির হাত মেলানোর মধ্য দিয়ে।

 

পাঁচ.

 

ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কীভাবে এগোতে হবে, সেটাই যেন তারা জানে না। তারা এখনো ষাট-সত্তরের দশকের ঢঙে চিন্তা করছে বলে মনে করেন অনেকে। 

 

ষাট-সত্তরের ওই সময়ে ফিফা অনেকটা অপেশাদারি সংগঠনই ছিল, যাদের মূল কাজ ছিল অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে দেখে রাখা, আর বিশ্বকাপের আয়োজন। ব্যবসা তাদের উদ্দেশ্যে তখনো ছিল না। ফিফার অর্থের উৎস তখনো মূলত ছিল বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টগুলোর টিকিটের টাকা, আর টাকা যে দেয়, তার গুরুত্ব তো বেশি থাকেই! সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তখন সদস্য দেশগুলোর ভোটের গুরুত্ব ছিল বেশি। 

 

সে সময়ে কলোনিয়াল শাসন থেকে বেরোনো আফ্রিকান অনেক দেশ কলোনি-বিদ্বেষী মানসিকতার দিক থেকে এক সুতোয় বাঁধা ছিল। জোট বেঁধে সে সময়ে বিশ্বকাপে আফ্রিকান দেশের অংশগ্রহণ, ফিফার টাকায় আফ্রিকার ভাগ বাড়ানোর মতো কিছু সিদ্ধান্ত নিজেদের পক্ষে নিয়ে নিতে পেরেছিল তারা। ইসরায়েল তখন ছিল এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) অংশ। আফ্রিকানদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে কুয়েতি অ্যাসোসিয়েশনের সে সময়ের সভাপতি আহমেদ আল-সাদুন ইসরায়েলকে এএফসি থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালে সফলও হয়েছেন আল-সাদুন, ইসরায়েলকে বের করে দেয় এএফসি!  

 

মাঝে যুগোস্লাভিয়া ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলকে উয়েফার অংশ করে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেও কুয়েতে আল-সাদুনের উত্তরসূরি ফাহাদ আল-আহমেদের প্রচেষ্টায় তা আর হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালে উয়েফার সহযোগী সদস্য হওয়ার আগ পর্যন্ত (১৯৯৪ সালে পূর্ণ সদস্য হয়েছে) ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক ফুটবলে কোনো ঠিকানা ছিল না। 

 

কিন্তু সে সময়ের ফিফা, আর এখনকার ফিফায় তো সুমেরু আর কুমেরুর ব্যবধান! ফিফা এত স্পনসরশিপ আর টিভিস্বত্ত্বের পথে হাঁটতে শুরু করেছে সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে। স্বাভাবিকভাবেই, তখন থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও ফিফার রীতিনীতিতে আসতে থাকে বদল। আগে যা ছিল ‘বটম-আপ’ অ্যাপ্রোচ–সদস্যদের রায়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হতো সিদ্ধান্ত, পরে তা পরিণত হয়েছে ‘টপ-ডাউন’ অ্যাপ্রোচে–সভাপতিসহ উচ্চপদস্থ কর্তাদের ইচ্ছায় কর্ম। তাঁরাই স্পনসরশিপ, টিভি স্বত্ত্বের চুক্তিগুলোতে সই করেন কিনা! 

 

কিন্তু স্পনসরদের অর্থের সমান্তরালে পর্দার আড়ালে তো তাদের দাপটও বেড়েছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে স্পনসর কোম্পানিগুলো যে দেশের, সেসব দেশের দাপট। ইসরায়েল কেন নিষিদ্ধ হচ্ছে না, রাশিয়া কেন চার দিনেই নিষিদ্ধ হলো–এই উত্তরটা সম্ভবত এই স্পনসর কোম্পানি, আর তাদের দেশের সরকারের প্রভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে।

 

ফিফার মূল স্পনসর কারা? অ্যাডিডাস (জার্মানি), কোকা-কোলা (যুক্তরাষ্ট্র), হিউন্দাই (সাউথ কোরিয়া), কাতার এয়ারওয়েইজ (কাতার), ভিসা (যুক্তরাষ্ট্র), আরামকো (সৌদি আরব), লেনোভো (চীন), ওয়ান্দা গ্রুপ (চীন)…। আইওসির ক্ষেত্রেও চিত্রটা প্রায় একই–মূল স্পনসরদের চারটিই (কোকা-কোলা, এয়ারবিএনবি, পিএন্ডজি, ভিসা) যুক্তরাষ্ট্রের, এর বাইরে ডেলয়েট আর করোনা-জিরোতেও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারি আছে। একটি করে কোম্পানি চীনের (আলিবাবা), সাউথ কোরিয়া (স্যামসাং), সুইজারল্যান্ড (ওমেগা) ও জার্মানির (আলিয়ান্স)। এই দেশগুলোর প্রায় সবাই-ই ইসরায়েলের পক্ষে, চীন ছাড়া প্রায় সবাই-ই প্রকাশ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়া-বিরোধী। 

 

ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করতে গেলে তাই স্পনসরদের–আরও বেশি করে স্পনসর কোম্পানিগুলোর দেশের দিক থেকে চাপ আসে। এসেছে, আসবে। রাশিয়ার বেলায় এ চাপটা কম। টাকা-পয়সা ঠিক করে দেয় সিদ্ধান্ত, আর টাকা-পয়সার হিসাব ঠিক করে দেয় রাজনীতি।

 

খেলার সঙ্গে না সেটার সম্পর্ক নেই?

 

লেখক: সাংবাদিক

 

[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *