Bangla News
লালমনিরহাট: তিস্তা, ধরলা আর সানিয়াজান নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি কৃষি ফসল।
এবার সেই ফসল একদিকে খড়ার পুড়ছে অন্যদিকে বন্যায় ডুবে নষ্ট হচ্ছে।
বন্যা আর খরা যেন জেলার কৃষিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে।
জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলাটি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা আয়তনের এ জেলায় পাঁচটি উপজেলা ও দুটি পৌরসভা রয়েছে। জেলার উত্তর সীমান্তে ভারত ও ধরলা নদী প্রবাহিত এবং দক্ষিণ সীমান্তে তিস্তা নদী প্রবাহিত। তিস্তা ধরলা নদী আর ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়া এ জেলার সীমান্তকে আগলে রেখেছে। উত্তর-দক্ষিণ সীমানায় দুই নদী আর মাঝে লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়ক ও রেলরুট পুরো জেলাবাসীর একমাত্র যোগাযোগের পথ। দুই নদীর মাঝেই জনবসতি আর চাষাবাদের মূল ভূখণ্ড।
অনাবৃষ্টির কারণে জেলায় এ বছর আমন চাষাবাদ কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। অনেক চাষি এবার বৃষ্টির অভাবে আমন চাষাবাদ করতে পারেননি। কেউ কেউ সেচ দিয়ে আমন চারা রোপণ করেছেন। মূলত পানির অভাবে বিঘ্ন ঘটেছে আমন চাষাবাদ ও পাট পচানো। প্রখর রোদে পুড়ে যাচ্ছে ফসলের মাঠ। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ মানুষ ও প্রাণিকুল। আমন চাষাবাদ বিলম্ব হলে বিলম্বিত হবে আগামী শীতকালীন সবজির চাষাবাদ। তাই শ্যালো মেশিন বা সেচ পাম্পের সেচ নিয়ে আমন চাষাবাদ করছেন অনেক চাষি। জেলার পাঁচটি উপজেলার কৃষিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে আমন চাষাবাদে খরচ বাড়ছে চাষিদের।
অন্যদিকে জেলার দক্ষিণ সীমান্তে প্রবাহিত তিস্তা নদীতে উজানের ঢলে পানি প্রবাহ বেড়েছে। মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে নদী তীরবর্তী অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। উজানে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় উজানের ঢলে তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ বেড়ে গিয়ে প্লাবিত হয় লোকালয়। নদীপাড়ের কিছু রাস্তা ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নদী তীরবর্তী এলাকার কয়েক হাজার পরিবার। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। ডুবে গেছে পাট খেত ও ভেসে গেছে জাগ দেওয়া পাট। শ্যালো মেশিনে সেচ দিয়ে আবাদ করা তিস্তাপাড়ের চাষিদের আমন খেতও ডুবে গেছে বন্যায়। বন্যার কবলে পড়ে বুধবার নদীপাড়ের সব বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ছিল।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, উজানের ঢলে মঙ্গলবার রাতে ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে তিস্তা নদীর পানি। তবে রাতভর বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বুধবার সকালে বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে পানি প্রবাহ। ফলে বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটে। উজানে পানির চাপ কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে বুধবার বিকেল ৩টায় তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ মিটার। যা বিপৎসীমার (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ মিটার) ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার মধ্যে অনেক এলাকার পানি নেমে গেছে। আজ রাতের মধ্যে লোকালয়ের পানিও নেমে যেতে পারে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে।
লালমনিরহাট জেলার সব উপজেলার তিস্তা পাড়ের ফসল ডুবেছে বন্যার পানিতে। অপর দিকে অনাবৃষ্টি তথা পানির অভাবে পুড়ছে আমন খেত। ফলে উজানের ঢলে লালমনিরহাটের একদিকে বন্যা আর একদিকে খরায় পুড়ছে চাষিদের ফসল।
তিস্তাপাড়ের আদিতমারীর গোবর্দ্ধন গ্রামের চাষি আজিজুল বলেন, দুই সপ্তাহ আগে শ্যালো মেশিনের পানি কিনে আমন চারা রোপণ করেছি। যা বন্যায় ডুবে গেছে। পানি কমলেও আমন খেত ডুবে আছে। উঁচু জমিতে পানির অভাবে চাষাবাদ করতে পারছি না। আর নিচু জমি ডুবে আছে বন্যার পানিতে। কৃষকের কপাল এমনই পোড়া ভাই।
সারপুকুর এলাকার চাষি বাংটু মিয়া বলেন, মাঝে মধ্যে সামান্য বৃষ্টি হলেও তাতে মাটি ভেজে না। পানির অভাবে আমনের চারা রোপণ করতে পারিনি। আমন চাষাবাদ দেরি হলে রবি মৌসুমের চাষাবাদও দেরি হবে। তাই বাধ্য হয়ে শ্যালো মেশিনে পানি তুলে আমন চাষ করছি। উপায় নেই। আমাদের কপাল পুড়ছে খরায় আর তিস্তা পাড়ের মানুষের কপাল পুড়ছে বন্যায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, উজানের ঢল কমে যাওয়ায় তিস্তা নদীর পানি প্রবাহও কমে এসেছে। ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা ধীরে ধীরে নিচ নামছে। ফলে লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতি যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বুধবার রাতের মধ্যে পুরো জেলার পানিবন্দি জনতা মুক্তি পাবেন।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. সাইখুল আরিফিন বলেন, পানির অভাবে শ্যালো মেশিন ও বরেন্দ্রের সেচ মেশিনের মাধ্যমে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে আমন রোপণ করা হয়েছে। বাকি জমিতেও আগামী আট/১০ দিনের মধ্যে রোপণ শেষ হবে। অপরদিকে তিস্তা নদীর বন্যায় ডুবলেও নদী তীরবর্তী জমিতে বর্তমানে তেমন কোনো ফসলের খেতে নেই। তাই বন্যায় কৃষিতে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং পানি আসায় আমন রোপণে সুবিধা হবে, পাট জাগ দিতেও সুবিধা হবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বন্যার পানিও নেমে যাচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তালিকা পেলে তাদের পুনর্বাসন করা হবে।
এসআই