Google Alert – সেনাপ্রধান
‘আমরা হানাহানি, বিদ্বেষ চাই না। বিভিন্ন মত থাকতে পারে, কিন্তু অবশেষে আমরা সবাই সবাইকে যেন শ্রদ্ধা করি।
একে অপরের বক্তব্য, মতামতকে যেন শ্রদ্ধা করি। আমাদের নিজস্ব মতামত থাকবে, সে অনুযায়ী আমরা অবশ্যই কাজ করব। কিন্তু একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ যেন থাকে, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখা অত্যন্ত জরুরি। আমরা শান্তির দেশ চাই, শৃঙ্খলার দেশ চাই। ’
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৩ এপ্রিল রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে ‘সম্প্রীতি ভবন’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।
ওই দিনের অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সেনাপ্রধানের অনুরোধে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুরোধ রক্ষার জন্য সেনাপ্রধান প্রধান উপদেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ আমরা সবাই মিলে এই দেশ-জাতিকে একটা শান্তির জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। ’
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশ গঠনে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, আমি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে দেবো না— এটা আমার স্পষ্ট অঙ্গীকার।
১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির আয়োজনে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় ঐক্য, সংস্কৃতি ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। এখানে ধর্ম নয়, মানবিকতা বড়। আমরা সবাই এই মাটির সন্তান। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, আজ আমাদের সবার উৎসবের দিন আমরা সবাই মিলে পালন করব এবং পালন করছি, ভবিষ্যতেও পালন করব। ’
ওইদিন তিনি বরাবরের মতোই আশা প্রকাশ করেন, দেশ শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরবে এবং এ দেশে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করব। ’
২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে ২০০৯ সালে পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদাতবরণকারী শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে, চিন্তা-চেতনায় বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু দিন শেষে যেন আমরা সবাই দেশ ও জাতির দিকে খেয়াল করে সবাই যেন এক থাকতে পারি। কেবল এক থাকলেই এ দেশ উন্নত হবে, সঠিক পথে পরিচালিত হবে। না হলে আমরা আরও সমস্যার মধ্যে পড়ে যাবো। ’
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সেনাপ্রধানের দূরদর্শী ইতিবাচক ভূমিকার কথা অবিস্মরণীয়।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বাঁকবদলকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেছিল দেশ ও জাতিকে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার (১৩ মে) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, ‘চব্বিশের জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থান ও এর পরবর্তী নয় মাস বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশের ক্রান্তিলগ্নে এক বাঁকবদলকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশকে চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছেন। তার গতিশীল, পরিপক্ব ও দূরদর্শী নেতৃত্বে অনুপ্রাণীত সেনাবাহিনী শত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে। এই পথচলায় সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনী দেশের স্থতিশীলতা, নিরাপত্তা, ঐক্য ও গতিশীলতা প্রদানে অতি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে জনগণের আস্থা লাভ করেছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন সম্প্রতি তার একটি লেখায় ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ‘জনগণের কাছে ক্ষণিকের মধ্যেই সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধানের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, ‘ছাত্রদের বুকে গুলি নয়’ খবরটি বিশ্বের সব স্থানে পৌঁছে গেল। বাংলাদেশ প্রবেশ করল নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে। ’
জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহত তরুণ যোদ্ধাদের এবং সেনাপ্রধানের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি তার লেখায় আরও বলেছেন, সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধান একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৬ অক্টোবর সেনাসদরে নির্বাচনী পর্ষদ ২০২৪- এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই সত্য স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ’
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শিল্প-কারখানাগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ৮ আগস্ট ঢাকায় সেনাসদরে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
এ সময় তারা শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা চান। জবাবে দেশের সব নাগরিকের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বস্ত করেন সেনাপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সাপ্লাই চেইন ও বন্দরের নিরাপত্তা এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নির্বিঘ্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী সর্বদা তৎপর আছে। ’
অনেকের মতে দেশকে অস্থিতিশীল রাখতে কুচক্রী মহল সেনাপ্রধান তথা সামরিক বাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেনা দিবসের অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণাত্মক কথা না বলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারো কারো। কিন্তু কী কারণে আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি। ’
সেনাপ্রধান ও সামরিক বাহিনীকে নিয়ে বিরূপ সমালোচনা প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাকুর চৌধুরী বলেন, ‘পুট ইয়োরসেল্ফ ইন হিজ সুজ। তার অবস্থান বিচেনায় নিয়ে তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি একটি বাহিনীর প্রধান। তার নেতৃত্বেই এই বাহিনী পরিচালিত হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের অর্গানাইজেশনগুলোর মধ্যে যেটি সফলভাবে প্রকৃত দায়িত্ব পালন করছে সেটি সামরিক বাহিনী বা সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েও সামরিক বাহিনী একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনো পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। ’
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট যারা বিতাড়িত হলো, তারা কি খুব আনন্দের সঙ্গে চলে গেছে? আমাদের দেশ থেকে ভারত যেভাবে সাইফোনিং (অবৈধভাবে অর্থ সরিয়ে নেওয়া) করত, ভারতকে এই গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল যে সারা জীবন সাইফোনাস করতে পারবে। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতের জাতীয় স্বার্থের ওপর আঘাত পড়েছে। ছাত্র-জনতা, সামরিক বাহিনী, অন্তর্বর্তী সরকার সবাই মিলেই এই আঘাত হানা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স যেত, সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক, ভু-রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে বিশাল ধাক্কা খেয়েছে ভারত। এই ধাক্কা থেকে যেভাবেই হোক উঠে দাঁড়াতে চাইবে দেশটি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি পাল্টে তাদের জন্য অনুকূল একটি পরিস্থিতি আনার চেষ্টা করবে তারা। সেটি যাতে না হতে পারে তার জন্য কাজ করছে সামরিক বাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামেও দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল, সেনাবাহিনী তা হতে দেয়নি। আমাদের জাতীয় স্বার্থ কেউ যদি জলাঞ্জলি দিতে চায়, তার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ তো দাঁড়াবেই, সবার আগে দাঁড়াবে সামরিক বাহিনী। সেনাবাহিনী প্রধান সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেন। নানা দিক থেকে ঐক্য বিনষ্টের পাঁয়তারা চলছে, অপপ্রচার, উসকানি চলছে— এসব বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন। এটা এজন্য বলেন, কোনো ফাঁদে যেন আমরা পা না দিই। ’
ভারতের কিছু সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ‘অভ্যুত্থান বা অস্থিতিশীলতার’ ভিত্তিহীন খবর প্রকাশ হয়। অন্তর্বর্তী সরকার একে ‘শুধু ভিত্তিহীনই নয়, অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে প্রতিক্রিয়া জানায়।
১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক দেশ, যার সশস্ত্র বাহিনীসহ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আছে; যারা ধারাবাহিকভাবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা, জনগণ এবং সংবিধান রক্ষায় পেশাদারি এবং প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে।
২৪ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে (অফিসার্স অ্যাড্রেস) সেনাপ্রধান সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তাদের আত্মত্যাগ দেশ সব সময় স্মরণ করবে।
তিনি সবাইকে ধৈর্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যে কোনো উসকানিমূলক বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া না দেখাতে পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, এমন কিছু করা যাবে না, যাতে উসকানিদাতাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ওইদিন সেনাপ্রধান একটি হাদিস শেয়ার করেন; যাতে বলা আছে, ‘শক্তিশালী সে নয়, যে তার শক্তি দিয়ে অন্যকে পরাস্ত করে, বরং শক্তিশালী সে, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। ’
এ ছাড়া তিনি বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে জাতির কোনো ক্ষতি হবে না। সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের সফল আয়োজন এবং ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসাতে।
সম্প্রতি ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি আফটার শেখ হাসিনা’ নামে আলজাজিরার একটি বিশেষ তথ্যচিত্র প্রকাশ হয়। এতে উঠে আসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং জনগণের প্রতি তাদের সহমর্মিতার চিত্র। এতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয় আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আলজাজিরাকে জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যেতে পারে না।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিরলস প্রচেষ্টা: সেনাবাহিনী দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গত প্রায় নয় মাস ধরে নিরলসভাবে যে ধরনের কাজ করে চলেছে, সে সম্পর্কে সেনা সদর আয়োজিত প্রেস ব্রিফিং থেকে ধারণা পাওয়া যায়।
১৭ এপ্রিল এ ধরনের প্রেস ব্রিফিং থেকে জানানো হয়, ৫ আগস্টের পর থেকে ওই সময় পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সমন্বিত তৎপরতায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত মোট সাত হাজার ৮২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একই সময় মোট নয় হাজার ৩৭০টি অবৈধ অস্ত্র ও দুই লাখ ৮৫ হাজার ৫২ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। গত দুই মাসেই বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত দুই হাজার ৪৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, তালিকাভুক্ত অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী, অপহরণকারী, চোরাচালানকারী, প্রতারক ও দালালচক্রের সদস্য, চাঁদাবাজ, ডাকাত ও ছিনতাইকারীও রয়েছে।
ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, বিগত সময়ে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের ১৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী। শিল্পাঞ্চল ছাড়াও সেনাবাহিনী গত দুই মাসে ২৩২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত ঘটনা ৩৭টি, সরকারি সংস্থা বা কার্যালয়সংক্রান্ত ২৪টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৭৬টি এবং অন্যান্য ৯৫টি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময় যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী ওই সময় পর্যন্ত চার হাজার ৩৪০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এর মধ্যে ৪৩ জন চিকিৎসাধীন।
এর আগে ১৩ নভেম্বর অন্য এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষে বলা হয়, কোনো ধরনের পরিস্থিতিতে যেন বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত না হয়, সে বিষয়ে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিরোধে। কিছু প্রতিরোধের ঘটনা হয়তো অনেক সময় জনসমক্ষে আসে না। শিল্প খাতে এ পর্যন্ত ছয় শতাধিক শ্রমিক অসন্তোষের (আনরেস্ট) ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো সহিংস ছিল, বিশেষ করে শুরুর দিকের যে ঘটনাগুলো। সেনাবাহিনীর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা অন্যান্য বাহিনীও ছিল, যদি সময়মতো গিয়ে তাদের (শ্রমিক) শান্ত করার ব্যবস্থা না করা হতো, তাহলে হয়তো এর থেকে অনেক বেশি ঘটনা ঘটতে পারত।
ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা: জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরপরই দেশের পূর্বাঞ্চল তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়। এই বিপর্যয়ে সেনাবাহিনীসহ সামরিক বাহিনীর উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা ছিল প্রশংসনীয়। বন্যা-পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৩শ পরিবারের ঘর নির্মাণের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীকে। এজন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল থেকে প্রাথমিকভাবে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী অত্যন্ত পরিশ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে ২৪ কোটি ৯৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ঘরগুলোর নির্মাণকাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে।
৩০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ঘরগুলো হস্তান্তর অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘সঠিকভাবে কাজ করার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো তা আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে। ’
অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘ভবিষ্যতেও এ ধরনের দায়িত্ব দেওয়া হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তা পালন করার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকবে। ’
যে ক্ষতির আশঙ্কা: ‘মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাকুর চৌধুরী বলেন, সামরিক বাহিনী সারা দেশে মাঠে নেমে এখন যে দায়িত্ব পালন করছে সেটি তাদের জন্য আদর্শিক নয়। এটা তাদের প্রকৃত দায়িত্ব নয়। প্রকৃত দায়িত্ব থেকে যতই তাদের দূরে রাখা হবে, ততই তাদের ক্ষতি করা হবে। এই ক্ষতিটা যত কম হয় ততই ভালো। তবে যেহেতু দেশের প্রয়োজন, সে জন্য তারা এই দায়িত্ব পালন করছে। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য তাদের কাজ করতে হচ্ছে। পুলিশ এখনো পুরোপুরি সংগঠিত না। একেবারে জিরো অবস্থা থেকে পুলিশকে পুনর্গঠিত করার জন্য, পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য সময় দেওয়া হচ্ছে। এই সময়টা যত কম হবে ততই ভালো। সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনী যে ভূমিকা পালন করছে, সাবেক একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবেই নয়, এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও বলব, তা চমৎকার। যে কাজের জন্য তারা প্রশিক্ষিত নয়, সেই কাজ যতটা করছে তা মন্দ নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা হয়তো প্রত্যাশার জায়গায় যায়নি, কিছুটা সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে, সমালোচনা সরকারেরও হয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা, পরিস্থিতির ক্রমশ উন্নতি হয়েছে। ’
সূত্র: কালের কণ্ঠ