শহীদের পরিবারে কান্না থামেনি

Google Alert – আর্মি

জুলাই অভ্যুত্থানের সেই রক্তাক্ত দিন আজ ইতিহাস হলেও শহীদের মা-বাবার জীবনে তা এখনো প্রতিদিনের বাস্তবতা। শহীদ ফারহানের মা এখনও ভোরে ছেলের নাম ধরে ডাকেন-ভাবেন, হয়তো ছেলে ঘুমিয়ে আছে ওর ঘরে। ছেলের বই-খাতা, কলেজের ড্রেস সবকিছু প্রতিদিন গুছিয়ে রাখেন শহীদ নাফিজের মা। ছেলের পড়ার রুমে বসে প্রার্থনা করেন আর অঝোরে কাঁদেন। শহীদ আনাসের শেষ চিঠি বুকে জড়িয়ে প্রতিদিনই বিলাপ করেন তার বাবা-মা। এত দিনেও খুনিদের বিচার না হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন শহীদদের স্বজনরা। তারা বলছেন, খুনি-ফ্যাসিস্টদের বিচার হলেই কেবল শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। স্বজনদের যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমবে।

শহীদ নাফিজ : গত বছরের ৪ আগস্ট বিকালে ফার্মগেটের পথচারী সেতুর নিচে পুলিশ গোলাম নাফিজকে প্রকাশ্যে গুলি করে। এরপর মৃত ভেবে তার দেহ ড্রেনে ফেলে দেয়। সেখান থেকে তাকে তুলে এক রিকশাচালক হাসপাতালে নিতে চাইলে ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ হাসিনার সন্ত্রাসী বাহিনী বাধা দেয়। রিকশাচালকসহ নাফিজের দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। সম্প্রতি রাজধানীর মহাখালীতে নাফিজের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একটি রুমে তার ব্যবহৃত জামা-কাপড়, বই-খাতা, টুপি, ফটো অ্যালবাম, কলেজের ড্রেস গুছিয়ে রাখছেন মা নাজমা আক্তার। তিনি জানান, তার ছেলে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে নৌবাহিনী কলেজ ঢাকায় ভর্তি হয়েছিল। আর্মি অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখত নাফিজ। রুমে একটি বড় ব্যানার টানানো। এতে দেখা যায়, রিকশার পাদানিতে মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা নাফিজের রক্তাক্ত ছবি। ওইভাবেই তাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন রিকশাচালক। রুমটিতে এখন নামাজ পড়েন নাফিজের মা। কোরআন পড়েন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সন্তানের ব্যবহৃত টুপি, বই-খাতা, জামা জড়িয়ে বিলাপ করেন।

নাজমা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ছেলেকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করল, তাদের বিচার হচ্ছে না কেন। খুনিদের ফাঁসি নিশ্চিত করতে আর কত দিন লাগবে। সবার আগে খুনি হাসিনাসহ হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার সর্বোচ্চ বিচার সম্পন্ন করা হোক। তবেই আমার ছেলেসহ সব শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।

বড় ভাই গোলাম রাসেল বলেন, নাফিজ আমার ২ বছরের ছোট। সে-ই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর থেকেই নাফিজ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সে ১৭ ও ১৮ জুলাই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। ওই সময় পুলিশের রাবার বুলেটে সে আহত হয়। এরপর থেকে কিছুতেই ঘরে থাকতে চাইত না। ৪ আগস্ট সকালেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে বলেছিল, ভাই আমি কিন্তু বের হলাম, তুমি চিন্তা করো না। নাফিজকে ঘরে আটকে রাখার কারও ক্ষমতা ছিল না। সে বের হয়েই যেত, বলত- কেউ গুলি খেয়ে মারা যাবে, কেউ ঘরে বসে থাকবে, এটা হতে পারে না।

মা নাজমা আক্তার আরও বলেন, দেশে এখন কত কিছুই না হচ্ছে। শুধু খুনিদের বিচার হচ্ছে না। বিচার কবে হবে, এর নিশ্চয়তা কে দেবে। আর কতদিন লাগবে, খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলাতে। তিনি বলেন, নাফিজকে যখন রিকশার পাদানিতে তোলা হলো, তখনও তার প্রাণ ছিল। সে রিকশার একটি রড ধরে রেখেছিল। কিন্তু হাসিনার গুন্ডাবাহিনী আমার ছেলেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেয়নি।

শহীদ আনাস : বাবা-মায়ের উদ্দেশে জুলাই অভ্যুত্থানে লেখা শহীদ আনাসের চিঠি বুকে জড়িয়ে এখনও কাঁদেন মা-বাবা। সম্প্রতি রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় শহীদ আনাস সড়কের ৯১নং বাসায় গিয়ে দেখা যায়, আনাসের মা-বাবা, নানা আর ছোট দুই ভাই বসে শহীদ আনাসের জন্য প্রার্থনা করছেন। মা-বাবা স্বজনরা জানান, ৫ আগস্ট ভোরেই আনাস ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। এর আগে একটি চিঠি লিখে পড়ার টেবিলে রেখে যান। তাতে লেখা ছিল, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না…।’

আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি বলেন, আনাস ছাড়া আমি ভীষণ একা। ছেলের গুলিবিদ্ধ শরীরটা প্রতিমুহূর্ত কাঁদায়। এ সময় কান্না করছিলেন আনাসের বাবা, নানা আর ছোট্ট দুই ভাইও। সানজিদা বলেন, এখন সবাই আমাকে শহীদ আনাসের মা বলে ডাকে। আমার বাপজান যেদিন শহীদ হয়, ওইদিন বিকালে খুনি হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় সবাই আনন্দ-উল্লাস করছিল। ওই সময় মিটফোর্ড হাসপাতালে আনাসের লাশ জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলাম।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, আনাস গেণ্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমিতে বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়ত। সে প্রকৌশলী হতে চেয়েছিল।

শহীদ ফারহান: ঢাকা সার্কিট হাউজ এলাকায় শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তার পড়ার কক্ষে সারি সারি বই। স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানী হবেন। দেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরবেন। ফারহান ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজধানীতে শহীদদের তালিকায় প্রথম নামটি ফারহানের। তার মৃত্যুতেই রাজধানীতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মা ফারহানা দিবা কুমকুম। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। ছেলের ঘরে দিনরাত বসে প্রার্থনা করেন। মাঝে মাঝে আনমনে ছেলেকে ডাকেন। ফারহানকে হারিয়ে পুরো পরিবারই শোকে স্তব্ধ। ফারহানের দেড় বছরের ছোট বোন সায়ীমা ইসলাম ফারিনও ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে অঝোরে কাঁদেন।

শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, হত্যা মামলা করেছি। আশা করছি, ন্যায়বিচার পাব। তবে বিচার দ্রুত করতে হবে। খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত সরকারের কোনো কাজই টেকসই হবে না।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *