Samakal | Rss Feed
শাড়ি চুড়ি নিয়ে প্রতিবাদ এবং এনায়েতপুর থানা
মতামত
আদনান মনোয়ার হুসাইন 2025-08-03
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ছিনতাইয়ে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা পুলিশের জন্য শাড়ি ও চুড়ি নিয়ে শনিবার বিকেলে থানায় হাজির হন। ছিনতাই রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ওসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিন দিনের আলটিমেটামও দেন তারা। ছাত্র ও যুবসমাজের এ প্রতিবাদ কর্মসূচির খবর রোববার সমকালে প্রকাশিত হয়।
একই দিনে পত্রিকাটিতে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেটির শিরোনাম– ‘ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় এনায়েতপুর থানা’। ২০২৪ সালের ৪ আগস্টে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৫ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার বর্ষপূর্তির একদিন আগে ওই থানা পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই নিয়ে প্রতিবেদনটি করেন সমকালের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম খান রানা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৫ পুলিশ সদস্য হত্যার এক বছরেও পরিপূর্ণভাবে কাজ হয়নি। আগুনে পোড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে নামমাত্র লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে কাজ করছেন থানার সদস্যরা। থানাটি পরিদর্শনে যাননি কোনো উপদেষ্টা বা পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। এ নিয়ে হতাশ থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা।
সেদিন বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। তাতে দুই শিক্ষার্থী এবং একজন তাঁত শ্রমিক নিহত হন। পরে হামলায় তৎকালীন ওসি, পাঁচজন এসআই, একজন এএসআই ও আট কনস্টেবল নিহত হন। সেই সময়কার তিনজন এখনও থানায় কর্মরত আছেন। ১৩ জনকে অন্যত্র বদলি করা হয়। ওইদিন ১৬টি অস্ত্র ও সহস্রাধিক গোলাবারুদ লুটের ঘটনা ঘটে। এখনও ছয়টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, থানাটিতে বর্তমানে কর্মরত অনেক পুলিশ সদস্য জানান এখানে কাজ করতে তাদের মধ্যে অস্বস্তি আছে। পুলিশের মনোবল ফেরাতে কোনো কাউন্সেলিং করা হয়নি। এমনকি পুড়িয়ে দেওয়া ভবনটি যথাযথভাবে মেরামত করা হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে তাদের মনে উদ্বেগ রয়েছে। যারা সেদিন আহত হয়েছিলেন তারা নিজ উদ্যোগে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানান। থানার পাশের বাজারের চায়ের দোকানি জানান, পুলিশ সদস্যরা আগে চা খেতে আসতেন, লোকজনের সঙ্গে গল্প করতেন। এক বছর ধরে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না।
এটা অজানা নয় যে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশই ছিল সবচেয়ে বেশি মারমুখী। বিক্ষোভকারীদের ওপর তাদের সরাসরি গুলি চালানোর কথা সংবাদমাধ্যমে এবং জাতীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ সময় নিহত হন অনেক পুলিশ সদস্যও। পুলিশ সদরদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, গণঅভ্যুত্থানের সময় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের ১৪, সিরাজগঞ্জে ১৪ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এর বাইরে খুলনা, ঢাকা জেলা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, গাজীপুরসহ কয়েকটি জেলায় বাকি ১৬ জন নিহত হন (বাসস, ২৫ অক্টোবর ২০২৪)।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বারবারই পুলিশ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কথা উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বাহিনীকে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। শিগগিরই পুলিশ শতভাগ কাজে ফিরবে বলে বারবার জানানো হয়েছে।
মাঠের বাস্তবতা কেমন, এনায়েতপুর থানার চিত্রই সেটা বলছে। যে থানায় ১৫ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, সেখানে এখন যারা কর্মরত তাদের মনে অস্বস্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের মনোবল ফেরাতে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। পুলিশ সদস্যরা বলেছেন, তাদের কোনো কাউন্সেলিং করা হয়নি। মনোবল ফেরানোর কোনো উদ্যোগের কথাও বলতে পারেননি তারা। তাদের যে আক্ষেপ, তা অমূলক নয়। হত্যা ছাড়াও সেদিন থানায় অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে একটি। তাতে আসামি করা হয়েছে চারজন রাজনৈতিক নেতাকে। আর অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় ছয় হাজার জন। এ নিয়েও পুলিশ সদসদের মনে ক্ষোভ রয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই পুলিশ বাহিনী প্রয়োজন। এটি ছাড়া চলা যে অসম্ভব তা গত বছরের ৫ আগস্টের পরের কয়েক দিন টের পাওয়া গেছে। ডাকাতি আতঙ্কে পাড়ায়-মহল্লায় নিজেদেরই টহল দিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তখনই জোরেশোরে আওয়াজ উঠেছিল– পুলিশ নেই কেন!
ভৈরবে শাড়ি চুড়ি নিয়ে যে প্রতিবাদ করা হয়েছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা কতটুকু রুচিসম্মত, একটি বাহিনীর জন্য কতটা মর্যাদাহানিকর তা ভেবে দেখা উচিত। এমন কর্মকাণ্ড পুলিশকে চাঙ্গা করবে নাকি আরও হীনম্মন্যতায় ভোগাবে, এমন কর্মসূচি নেওয়ার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু চাপ দিয়েই কি কাজ আদায় করা যায়?
গত ১৯ মে গভীর রাতে ধানমন্ডিতে একজন প্রকাশককে গ্রেপ্তারে অনৈতিকভাবে পুলিশকে চাপ দিলে তিনজনকে আটক করা হয়। এতে থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটে। ১৫ ঘণ্টা পর ওই তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় (সমকাল, ২১ মে ২০২৫)। গত ২৬ জুলাই গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় চাঁদাবাজির আগে ভুল তথ্য দিয়ে পুলিশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার দাপট আর সাবেক এমপির স্বামীকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো। এই পুলিশ আর কারও ডাকে কোথাও যাওয়ার আগে দুইবার ভাববে।
এত বড় অভ্যুত্থানের পরও কিছু কিছু পুলিশ সদস্যের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। গত ২৫ জুলাই বিডিনিউজের এক খবরে বলা হয়, ঢাকার মোহাম্মদপুরে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের অভিযোগ নিয়ে থানায় যাওয়ার পর পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে গড়িমসির অভিযোগ তুলেছেন এক ভুক্তভোগী। মোহাম্মদপুর থানার ওসি তাঁকে বলেন, ‘আমি ওসি হয়েও এই কম দামি ফোন ব্যবহার করি, আপনি এত দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই!’ অভিযোগকারী বলছেন, থানায় যাওয়ার পর ‘অভিযোগ লেখার জন্য অতিরিক্ত মানুষ’ নেই বলেও তার সঙ্গে অসহযোগিতা করা হয়। পরে অভিযোগ লেখার জন্য কাগজ দেওয়া হলেও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য তাঁকে বলেন, ‘কলম নেই’।
পুলিশের এ উভয়সংকট কাটবে কবে? পুলিশ সদস্যরা এ দেশেরই মানুষ। এক ব্যক্তির দায় অন্যের ওপর যেতে পারে না। জুলাই-আগস্টে যারা অপরাধ করেছেন তাদের বিচার হতেই হবে। একই সঙ্গে বাহিনীর বাকি সদস্যদেরও খোলা মনে বরণ করে নিতে হবে। শুধু কথার প্রলেপে তাদের অসুখ ও ক্ষত যে সারবে না তা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
সোয়া দুই লাখের কম সদস্যের এ বাহিনীর গত এক বছরেও সংস্কার হলো না। এ সময়ে মনোবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা অনেক কথাই বলেছেন। পুলিশ সংস্কার কমিশনও তাদের সুপারিশ দিয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়ন হলে সংকটের সমাধান হবে বলে আশা করা যায়। এ জন্য সব পক্ষকেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তাতে আখেরে এ বাহিনী এবং দেশের জনগণেরই উপকার হবে।
আদনান মনোয়ার হুসাইন: সহকারী বার্তা সম্পাদক, সমকাল