Google Alert – সামরিক
বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে এখন গড়ে ৩৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হবে। প্রতিযোগি অন্যদেশগুলোর তুলনায় এই হার সহনীয়, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে সহসা ধস নামার তেমন সম্ভাবনা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিয়ে ঘাটতির উদ্বেগ কমানোর প্রয়াস ছিল, তেমনই অন্য বৈদেশিক বাণিজ্যিক অংশীদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। একইসঙ্গে জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। এর প্রভাব এবং ফলাফল সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি বাণিজ্যিক অংশীদার চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন– কী প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটির ওপরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক নির্ধারণ করেছে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অব্যহত থাকবে।
২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণের মাধ্যমে সব আলোচনা শেষ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি গতিশীল আলোচনা। দুইপক্ষ কিছু বিষয় এখনই করবে বলে একমত হয়েছে, কিছু বিষয় সামনের দিনগুলোতে বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা অব্যহত থাকবে এবং কিছু বিষয় নিয়ে দুইপক্ষ একমত হয়নি। ফলে সামনের দিনগুলোতে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অমীমাংসিত বিষয়ে এবং দুইপক্ষের জন্য লাভজনক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার আলোচনা অব্যহত থাকবে।
সম্পর্ক ভালো হলে সামনের দিনগুলোতে এই শুল্ক কমতেও পারে, আবার তেমন ভালো কোনও অগ্রগতি না হলে বেড়েও যেতে পারে। এ জন্য বর্তমান শুল্ক নির্ধারণকে চূড়ান্ত ফলাফল মনে করে আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগার কোনও সুযোগ নেই এবং সেটি করলে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি দেখা হবে বলে তিনি জানান।
কী কী বিষয়ে ঐকমত্য
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ সরকার গম, সয়াবিন ও জ্বালানি আমদানি করবে। এছাড়া মার্কিন কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজও কেনার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি খাতকে আরও বেশি আমদানির জন্য উৎসাহিত করার বিষয়ে একমত হয়েছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় কমানো বা মার্কিন মোটরগাড়ির ওপর শুল্ক কমানোর বিষয়ে রাজি হয়নি বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয়েছে, সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় নির্ভর করে চাহিদা, দাম ও ক্রয় শর্তের ওপর। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বাংলাদেশের এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। অন্যদিকে মোটরগাড়ির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক সুবিধা দিলে, সেটি জাপানকেও দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন গাড়ি বাজারজাতকরণ বিশেষ সুবিধা পাবে না। মাঝখান থেকে বাংলাদেশ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।
বাংলাদেশে মেধাস্বত্ব অধিকার লঙ্ঘেনের কারণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হয় অনেক মার্কিন কোম্পানি। এটি কমিয়ে আনার জন্য মেধাস্বত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনগুলোয় বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় অন্তর্বর্তী সতর্ক অবস্থান নেয়। মার্কিন পক্ষকে জানানো হয়, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও কনভেনশনে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে অন্যগুলোতে বাংলাদেশ অংশীদার হবে, তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সময় লাগবে।
কেন ২০ শতাংশ
বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ওপর ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন। শতাংশের এই হার হিসাব করে বের করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, কত শতাংশ আরোপ করা হবে, সেটি তারা হিসাব করে বের করেছে।
এই হিসাব কতটুকু যৌত্তিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথম ধাপে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল, তখন আমরা এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। এছাড়া মার্কিন কর্তৃপক্ষ শুধু পণ্যের বাণিজ্য হিসাব নিয়েছে। কিন্তু সেবা খাতের মাধ্যমে তারা যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে আয় করে, সেটি তারা বিবেচনায় নেয়নি।
নন-ডিসক্লোজার চুক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে এই আলোচনার জন্য একটি নন-ডিসক্লোজার চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে এই দর কষাকষিতে যা আলোচনা হয়েছে, সেটি দুইপক্ষ প্রকাশ্যে বলতে পারবে না।
এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা করছে, তাদের সবার সঙ্গে এই চুক্তি করা হয়েছে।
গ্যাট আর্টিকেল ২৪
বাংলাদেশ যেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দেবে, ওইগুলো অন্যদেশগুলোকে দেবে না। গ্যাট আর্টিকেল ২৪ অনুযায়ী একটি বিশেষ দেশকে এই সুবিধা দেওয়া যাবে এবং এ বিষয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাকে জানানো হবে।
ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনা শুধু বাণিজ্যিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় সংহত ও বৃদ্ধি করা এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে এই শুল্ক আলোচনায়। কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে, সেটি বেশি আলোচিত হলেও এই আলোচনায় অশুল্ক বাধা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, মেধাস্বত্ব, শ্রমাধিকার, ডিজিটাল অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ও প্রাধান্য পেয়েছে। সে জন্য বিষয়টিকে সামগ্রীক দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করে অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।
যেমন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে যতদূর সম্ভব পরিহার করার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। গোটা ডকুমেন্টে চীন বা অন্য কোনও দেশের নাম করে কোনও শর্ত উল্লেখ করা হয়নি। আবার জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে মোটরগাড়ির ওপর শুল্ক কমানোর বিষয়টিতে সম্মত হয়নি বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, এর একটি ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন রয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি, একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে। আমরা খোলামেলা আলোচনা করে আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি এবং মার্কিন সরকারও সেটি বিবেচনায় নিয়েছে।
ফলাফল ও প্রভাব
অন্যদেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আপাতদৃষ্টিতে ২০ শতাংশ শুল্ককে সহনীয় বলে মনে করা যায়। তবে অশুল্ক বিষয় যেমন মেধাস্বত্ব বা শ্রমাধিকার বা নিরাপত্তার শর্তগুলো নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মার্কিন শুল্ক আরোপের বিষয়ে জানতে চাইলে একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, চুরি, ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করলে এবং মালিকদের টাকা পাচার বন্ধ করলে, সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তিনি বলেন, শ্রমিকদেরও অকারণ আন্দোলন করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। রাজনীতির ধরণ পরিবর্তন করতে হবে।
আরেকজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, সারা বিশ্ব ও আমাদের প্রতিযোগিরা টিকে থাকতে পারলে ও লাভ করতে পারলে, আমাদেরও সেটি করতে পারা উচিত।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, প্রতিশোধ ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড জারি রাখলে, সমস্যা ঘনীভূত হবে। টাকাপাচার বন্ধ করলে ও সেই টাকা কারখানায় প্রযুক্তি ও শ্রমিকদের পেছনে ব্যয় করলে, উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট বাড়বে। সাধারণ জনগণের টাকায় প্রণোদনার ব্যবস্থা করার অতীত প্রবণতা পরিহার করা দরকার।