সরকারি অর্থে লোকদেখানো ‘ঘ্রাণ’ আর বিপণনে চলছে বিদেশি ফলের পাহাড়ি মেলা!

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

নিউজ ডেস্ক

‘পাহাড়ি ফলের ঘ্রাণ, বৈচিত্র্যময় প্রাণ’—এই স্লোগানে রাজধানীর বেইলি রোডে চলমান পাহাড়ি ফল মেলার উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষি-উৎপাদক ও জুমচাষিদের উৎপাদিত মৌসুমি ও দেশীয় ফলসমূহের বিপণন। তবে বাস্তবে গিয়ে দেখা গেল, মেলা যেন পরিণত হয়েছে বিদেশি জাতের ফল ও বিলাসবহুল আমের প্রদর্শনীতে। প্রকৃত ‘পাহাড়ি ফল’ যেমন বরই, কাউফল, তেঁতুল, জাম, চাকমা কলা, পুঁইফল বা লংগান-এর ছাপ কম, বরং অধিকাংশ স্টলে ঠাঁই পেয়েছে ‘কিং অব চাকাপাদ’, ‘চিয়াংমাই আম’, ‘ড্রাগন ফল’, ‘রেঞ্জ মধু’, ‘থাই পেয়ারা’, ‘কিউবান আনারস’ ইত্যাদি বিদেশি জাতের ফল ও চারা।

অনেক ক্রেতা-দর্শনার্থী অভিযোগ করছেন, ফলগুলোর দাম যেমন আকাশছোঁয়া, তেমনি অধিকাংশই আদৌ পাহাড়ে উৎপাদিত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। রাঙামাটির একাধিক কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ফলগুলোর একটি বড় অংশ বিদেশি জাতের, যেগুলো পার্বত্য এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে খাপ খায় না, বরং উন্নত জাতের হাইব্রিড বা ক্লোনাল গাছ রোপণের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে বাণিজ্যিক চাষ করা হচ্ছে—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি প্রকল্পের আওতায়।

স্টল ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ আমের নাম ও ধরন শুনলেই বোঝা যায় তা পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নয়। ‘চিয়াংমাই’, ‘চাকাপাদ’, ‘জিও’, এমনকি ড্রাগন ফল—এসবই মূলত থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীন বা ল্যাটিন আমেরিকার ভ্যারাইটি, যা স্থানীয় জুমচাষি বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নয়, বরং বিদেশি জাতের গাছ এনে পার্বত্য অঞ্চলে রোপণ করা কিছু বাণিজ্যিক উদ্যোক্তার হাতে উৎপাদিত। প্রশ্ন উঠেছে—এই কি তাহলে ‘পাহাড়ি ফলের ঘ্রাণ’? নাকি বিদেশি জাতের ফলের পুনঃপ্যাকেজিং?

সরকারি অর্থে লোকদেখানো ‘ঘ্রাণ’ আর বিপণনে চলছে বিদেশি ফলের পাহাড়ি মেলা!

ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের রাঙামাটির এক কৃষক বলেন, “আমরা নিজেরা জুমে উৎপাদিত সজিনা, আনারস, আমলকি, আম, লটকন নিয়ে এসেছি। অথচ দেখছি, বিদেশি ফলের স্টলেই সবচেয়ে বেশি ভিড়, বেশি গুরুত্ব, বেশি দাম। এটাকে কি পাহাড়ি ফল মেলা বলা যায়?”

মেলায় আসা এক ভোক্তা বলেন, “আমি ভেবেছিলাম এখানকার পাহাড়িদের উৎপাদিত মৌলিক ফল দেখতে পাব। কিন্তু এখানে তো ঢাকাতেও যেসব ফল পাওয়া যায়, সেগুলোকেই শুধু স্টল সাজিয়ে ‘পাহাড়ি’ বলা হচ্ছে।”

পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের ‘উপদেষ্টা’ সুপ্রদীপ চাকমার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এ মেলা সরকারের প্রকল্প বলেই প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে যাচাই-বাছাই ছাড়াই স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এমন কিছু ব্যবসায়ীকে, যাদের বেশিরভাগ পণ্য আসলে সমতল কিংবা দেশের বাইরের উৎস থেকে সংগ্রহ করা। ঢাকায় ‘পাহাড়ি হাব’ গঠনের ঘোষণাও এসেছে উপদেষ্টার পক্ষ থেকে। তবে অনেকে বলছেন, এটি যেন নিজের প্রভাবশালী বৃত্তের মধ্যেই বাজার তৈরি করার একটি কৌশল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ মূল পাহাড়ি উৎপাদকরা—বিশেষ করে প্রকৃত জুমচাষিরা—এখানে অনুপস্থিত।

সরকারি অর্থে লোকদেখানো ‘ঘ্রাণ’ আর বিপণনে চলছে বিদেশি ফলের পাহাড়ি মেলা!

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের বিদেশি জাতকে ‘পাহাড়ি’ বলে ব্র্যান্ড করে তুলে ধরলে স্থানীয় জাত যেমন—রাঙ্গুই আম, চাকমা কলা, জুম পেয়ারা বা পার্বত্য জলপাই—এইসব বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে। পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দরকার স্থানীয় জাতের সংরক্ষণ, গবেষণা ও উৎসাহ—না যে লোভনীয় প্যাকেজিংয়ে বিদেশি ফল ঢুকিয়ে পাহাড়ি পরিচয়ের অপব্যবহার।

উল্লেখ, পার্বত্য চট্টগ্রামে শতাধিক জাতের প্রাকৃতিক ও দেশীয় ফল উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে অনেকগুলো রয়েছে যেগুলো ওষধিগুণসম্পন্ন, দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রাকৃতিকভাবে অভিযোজিত। কিন্তু এসব ফলের বাজারজাতকরণে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে সমান মনোযোগ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, পাহাড়ি ফল মেলার মতো আয়োজন অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ হতে পারত, যদি সত্যিকার পাহাড়ি কৃষক, স্থানীয় জাত এবং খাদ্য-সংস্কৃতির প্রাধান্য নিশ্চিত করা হতো। এখন এই মেলা যেন হয়ে উঠছে একরকম ‘স্মার্ট বিদেশি ফল শো’, যেখানে ‘পাহাড়ি ঘ্রাণ’ কেবল শ্লোগানে সীমাবদ্ধ।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *