jagonews24.com | rss Feed
দুঃখজনকভাবে দেশে সরকারি সেবা খাতের দুর্নীতি যেন লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে দুর্নীতি দমনের কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য সর্বাগ্রে সরকারি কাজের ক্ষেত্রগুলো দুর্নীতিমুক্ত হওয়া জরুরি। সরকারি সেবা ঘুস-দুর্নীতিমুক্ত না হলে নাগরিক তার ন্যায্য অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়, সামাজিক অসন্তোষ বাড়ে, অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশে সরকারি সেবা খাতের ভাবমূর্তি এমন দাঁড়িয়েছে যে এটি ঘুস-দুর্নীতির অন্যতম আখড়া। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সিটিজেন পারসেপশন সার্ভেতে (সিপিএস) এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।
গত এক বছরে সরকারি সেবা নেওয়া নাগরিকদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ ঘুস-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এ জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সেবাগ্রহীতারা সর্বাধিক ঘুস-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন বিআরটিএতে। সেখানে সেবা নিতে গিয়ে ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় ৬১ দশমিক ৯৪, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ ও ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষ সেবা নিতে গিয়ে ঘুস ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। যে কোনো ধরনের দুর্নীতিই দেশে অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা। বিগত সরকারের শাসনামলের দিকে লক্ষ করলে সেটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত ‘সেবা খাতে দুর্নীতি; জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তথা বিগত সরকারের সুদীর্ঘ শাসনামলে সেবা খাতে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকার ঘুস লেনদেন হয়েছে। ২০২৩ সালে এ খাতে সার্বিকভাবে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বা পরিবার দুর্নীতির মুখোমুখি হয়েছে। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট, বিআরটিএ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এছাড়া সে বছর ঘুস দিতে হয়েছে প্রায় ৫১ শতাংশ পরিবারকে (খানা)। সর্বোচ্চ ঘুস লেনদেন হয়েছে বিচারিক, বিমা ও ভূমি সেবা খাতে। এসব তথ্য দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতাকেই ফুটিয়ে তুলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে ঘুস-দুর্নীতির রীতি পাল্টে ফেলা যায়। বিশেষত বিগত সরকার পতনের পেছনে বড় কারণ ছিল তাদের অতিমাত্রায় দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠা। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সে সরকারের পতন ঘটেছে আর গঠন হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ সরকারের কাছে দৃঢ় প্রত্যাশা রয়েছে জনগণের যেন শক্ত হাতে দুর্নীতি দমন করা হয়।
রাতারাতি দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত দৃষ্টান্ত রেখে যেতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
যদিও বাস্তবতা হলো এ দেশকে রাতারাতি দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত দৃষ্টান্ত রেখে যেতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতিবিদরাও এ বিষয়ে জোর দিয়ে আসছেন। তাদের মতে, দুর্নীতি নিরসন ছাড়া দেশের অনেক সম্ভাবনা অকার্যকর রয়ে যাবে। আর দুর্নীতি দূরীকরণে দুর্নীতিবাজদের দৃশ্যমান শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেশে সরকারি সেবা খাতে সবচেয়ে বেশি ঘুস ও দুর্নীতির শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে সেবাগ্রহণকারী জনগণ। বিআরটিএর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ একেবারেই নতুন নয়। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে দালাল চক্রের সরব উপস্থিতি নিয়ে। তাদের মাধ্যমেই চলে ঘুস-বাণিজ্য। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের নিবন্ধন, সনদ এবং হালনাগাদের জন্য বিআরটিএতে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয়। বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে বিআরটিএর ৩৫ কার্যালয়ে গত ৭ মে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযানকালে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পরীক্ষায় ফেল করলেও অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে পাস দেখানো, ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাস করতে ঘুস লেনদেন, বিনা নোটিশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিত না থাকা, দালাল দিয়ে কার্যালয়ে সেবাদানের প্রমাণ পান অভিযানকারীরা। অভিযানে দুরবস্থা দেখা গেছে যশোর, শেরপুর, নীলফামারী, বরিশাল, বাগেরহাট, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে।
এসব জেলায় বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়ে। যেখানে দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা ছিল, সেখানে এটিই এক অভ্যন্তরীণ গোলযোগপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বলা বাহুল্য, দেশের সড়কে বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির পেছনে বিআরটিএর দায়িত্বশীল ও পেশাদারত্বে ব্যাপক ঘাটতি রয়ে গেছে। বিআরটিএর পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানেরও প্রায় একই দশা।
সরকারি কেনাকাটা থেকে শুরু করে জমি বরাদ্দ, বদলি, নিয়োগ—প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতি বিদ্যমান। বিশেষত নিয়োগ-বাণিজ্য এখন প্রশাসনিক দুর্নীতির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা না থাকার সুযোগে তালিকাভিত্তিক ঘুস আদায় হচ্ছে। এ অবস্থায় এক শ্রেণির তদবিরকারী চক্রও গড়ে উঠেছে, যারা দুর্নীতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। উচ্চ থেকে নিম্ন সব পর্যায়ে মানুষকে ঘুস দিতে হচ্ছে।
এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং আইন প্রয়োগে কঠোরতা আনার পাশাপাশি দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করতে হলে জনগণকে সচেতন হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় মানুষ দ্রুত কাজ করাতে বা নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ঘুস দেয়। জনগণের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দূর না হলে দুর্নীতি পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হবে না। তাই জনগণের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা থাকাটা জরুরি। আর যদি তা না হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
দুনিয়ার ছোটবড় সব দেশেই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি বিদ্যমান। তবে এ দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা তুলনাহীন, যা দেশের সার্বিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত করেছে। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও বড় বাধা দুর্নীতি। দেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে রয়েছে তার জন্য দায়ী বিগত সরকার ও তার ঘনিষ্ঠজনদের অর্থনীতিতে করা লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট। দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারলে এ পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। সেই সাথে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএফএ/এএসএম