Samakal | Rss Feed
সহকর্মীর কেউ কারাগারে, কেউ পলাতক, মাথায় রাখতে হবে
বাংলাদেশ
সমকাল প্রতিবেদক 2025-08-09
জনপ্রশাসনের যারা দুর্নীতি করেছেন, তাদের কেউ কারাগারে, কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন– এসব মাথায় রেখে অস্তিত্ব রক্ষায় কাজ করার তাগিদ এসেছে এক সেমিনারে। সেখানে বলা হয়, জনগণ প্রশ্ন করতে শিখে গেছে। এখন আর দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে না।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ইস্কাটনে জনপ্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা প্রশাসনকে দলবাজি ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা গড়ে উঠেছে, তাতে এখন দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে না। জনপ্রশাসনকে এখন চিন্তা করতে হবে, কোন পথে যাবে? পথ দুটি। এক, এতকাল যে পথে চলেছি; অন্যটি হলো– নতুন পথে চলা। পুরোনো পথে ফিরব নাকি আত্মবিশ্লেষণ করে নতুন পথ গড়ব, তা চিন্তা করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন গত ২০-২৫ বছর কোনো কাজ করেনি। দলীয়করণের মাধ্যমে এ সার্ভিসের ভবিষ্যৎ নষ্ট করা হয়েছে। এখন অ্যাসোসিয়েশনের সদিচ্ছা দেখে আত্মবিশ্লেষণে সেমিনার করছি। ’৭২ সালে হোসেন তৌফিক ইমামের নেতৃত্বে সার্ভিসটা নষ্ট হতে শুরু করে। আর মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে ’৯৬ সালে নষ্টের পূর্ণতা পায়। প্রশাসনের একাংশ রাজনীতির মধ্যে ঢুকে গেল। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের এককভাবে দায়ী করা যাবে না। আমাদেরও দায় আছে। কীভাবে আমরা সে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, সে চেষ্টা করতে হবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সচিব সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া বলেন, আমরা বছর বছর শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিকুলাম পরিবর্তন করেছি। এটি মূলত একটি ব্যবসা। আমাদের বই ছাপাতে হয়েছে অন্য দেশে। কেন দেশেই ছাপা গেল না? কারণ আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়তে পারিনি। প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে। টাকা পাচারে জড়িত ব্যক্তিও দুদকের প্রধান হয়েছেন।
তিনি বলেন, জনপ্রশাসনকে দলীয় রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে হবে। আমরা সরকারের কাজে ন্যস্ত, কোনো দলীয় লোক নই। আইনসংগত না হলে তা বিনয়ের সঙ্গে বলতে হবে। আমরা এতদিন তা বলিনি। বললে এতটা অকার্যকর হতো না প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মায়।
সেমিনারের মুখ্য আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা দুর্বল করে ফেলেছি। মানুষ এখন প্রশ্ন করতে শিখে গেছে। ফলে ইচ্ছা থাকলেই দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে না। আর রাজনীতি থেকে প্রশাসন আলাদা, কতটা সম্ভব? এটি পরিষ্কার, প্রশাসনে যারা থাকবেন, তারা যোগ্য হবেন। পেশাদারিত্বের সঙ্গে নীতির বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু
রাজনৈতিক নেতার কথা না মানলে
যদি তার মুখোমুখি হতে হয়, অবশ্যই সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আবদুস সাত্তার বলেন, অর্জন কিছু নেই, তা নয়। কিন্তু এক বছরে আমরা দুর্নীতি কমাতে পারিনি। জুলাই বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের চেতনা একটিই– ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে কর্মকর্তারা যা করেছেন, তা আর না করা।
তিনি বলেন, জনপ্রশাসনে কর্মরতদের দলীয় বৃত্তে না থেকে কাজ করতে হবে। বিগত সময়ে যারা দুর্নীতি করেছেন, আমাদের সহকর্মীরা। তাদের কেউ এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন; কেউ কারাগারে– এসব মাথায় রেখে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে কাজ করতে হবে। দলবাজি ও দুর্নীতি কমাতে না পারলে কপালে দুঃখ আছে। আমি হুমকি দিচ্ছি না। ডিসি-ইউএনও যা খুশি, করতে পারবেন না। মানুষ এখন বুঝে গেছে, কীভাবে কোথায় টাকা পাচার করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, আমাদের অনেক আইন রয়েছে, তার প্রয়োগ নেই। আমি মনে করি, আমাদের আর আইনের দরকার নেই। দরকার প্রয়োগ। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলেই অনেক কিছুর সমাধান হবে। আমাদের অন্তত চার সহকর্মী এখন কারাগারে। তারা আমাদের চেয়ে বড় পদে কাজ করেছেন। কিন্তু তারা কী সেসব ভোগ করতে পারলেন? এসব মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে।
জুলাই শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি বলেন, আমাদের আশা, আপনারা (জনপ্রশাসনে কর্মরতরা) কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করবেন না। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার বানিয়েছে কারা? জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা কী এ দায় এড়াতে পারেন? অন্যায় আদেশ মেনেছেন এবং কখনও ভাবেননি কত মানুষের ক্ষতি হচ্ছে? নির্বাচনে আপনারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি, তা কী অস্বীকার করতে পারবেন? তিনি বলেন, আমরা প্রশ্ন করতে শিখেছি। এই জেনারেশন আর এটি ভুলবে না। আমরা সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে যাব। আগামী নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের মোটিভ নিয়ে আপনারা কাজ করবেন না, এটাই প্রত্যাশা।
আয়োজক সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ ও সংসদ সচিবালয়ের সচিব কানিজ মওলা বলেন, প্রশাসনের যারা ফ্যাসিস্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন, তারা অপরাধ করেছেন। রাষ্ট্র আমাদের বেতন দেয়, জনগণের জন্য কাজ করার জন্য। আমরা যেন কোনো ফ্যাসিস্টের সহায়ক না হই। বর্তমান প্রশাসনের অগ্রজ যারা আছেন, তারা যেন আমাদের সঠিকভাবে কাজে লাগান, সে অনুরোধ রইল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন
বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবীর বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা জনগণ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। নিজেদের অভিজাত মনে করেন তারা। কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে তাদের কাছে সাধারণ মানুষ ভিড়তে পারেনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক শাফিউল ইসলাম বলেন, শহীদ শাহরিয়ার খান আনাস আন্দোলনে যাওয়ার আগে মা-বাবার উদ্দেশে চিঠি লেখেন। এটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তা মা। আমি মনে করে, আগামী প্রজন্মের জন্য এটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ। সমাপনী বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম। আরও বক্তৃতা করেন শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী, শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ প্রমুখ।